বিমান নয়, ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন শামীম!
আকাশে উড়োজাহাজের শব্দ শুনে আপনি মনের অজান্তেই এখনো ছোটবেলার মত উপরের দিকে তাকান কি না, আমার জানা নেই, তবে আমি কাজটা করি। এই দুনিয়ার যেসব জিনিস দেখে আমি বিস্মিত হই তার মধ্যে একটা আকাশে উড়োজাহাজের ওড়া। পেশাগত কারণেই গত একযুগে শতবারের বেশি উড়তে হয়েছে। কিন্তু এখনও ভূমি থেকে উড়োজাহাজের শব্দ শুনলে আমি আমার দুই বছরের ছেলের মতোই আকাশে তাকাই বিস্ময় নিয়ে।
প্রতিবার মনে মনে ভাবি, মানুষ স্বপ্ন দেখলে সেটা বাস্তব করেই ছাড়ে। সেই ১১৬ বছর আগে মার্কিন প্রকৌশলী দুই ভাই অরভিল রাইট আর উইলবার রাইট প্রথম মানুষ-বহনযোগ্য উড়োজাহাজ তৈরি করেন। দিনে দিনে এর এতো উন্নতিসাধন হয়েছে যে নিত্য নতুন আধুনিক সব উড়োজাহাজ আসছে।
উড়োজাহাজের কারিগরি বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার ধারণা শূন্য। সাংবাদিকতার কারণেই বাংলাদেশ বিমানের প্রশিক্ষণ স্কুলে আমাদের কয়েকজন সাংবাদিককে বেসিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে বিমান। যদিও আমার ধারণা এখনও শূন্য রয়ে গেছে এবং আমি এখনও আগের মতোই বোকার মতো বিস্মিত থাকি এবং পাইলটদের আমার মনে হয় একেকজন ত্রাণকর্তা। তাদের হাতেই সব যাত্রীদের জীবন। সেই ঘটনাই যেন মিয়ানমারে আরেকবার প্রমাণ করলেন ক্যাপ্টেন শামীম।
মিয়ানমারে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার খবরটা আমরা বেশ আগেভাগেই পেয়ে যাই। ব্র্যাকের একজন সহকর্মী সেখানে ছিলেন। গণমাধ্যমে আরও পরে খবরটা আসে। গত দুদিনে এ সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ে নিশ্চিত হয়েছি, ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাতসহ সবমিলিয়ে প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ার কারণে ফ্লাইটটি অবতরণে সমস্যা হচ্ছিল। প্রথম দফায় নামতে ব্যর্থ হয়ে আকাশে চক্কর দিচ্ছিল কিছু সময়। দ্বিতীয় দফায় যখন নামতে যায় তখনই এটি রানওয়ে থেকে ছিটকে আছড়ে পড়ে পাশের খালি জায়গায়।
বিস্ময়কর ঘটনা হলো, ড্যাশ উড়োজাহাজটি যেভাবে আছড়ে পড়েছে, যেভাবে তিন টুকরো হয়েছে তাতে ৩৪ জন যাত্রীর সবাই মারা যেতে পারতেন, নেপালের মতো আরেকটা ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটতে পারতো। আমাদের সহকর্মী প্রিয়ম মারা যেতে পারতো, স্বজন হারাতেন অনেকেই। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এটিতে আগুন ধরেনি। এতেই প্রাণে বেঁচে যান যাত্রীরা। কিন্তু কেনো আগুন ধরলো না?
গণমাধ্যমের খবর আর ফ্লাইটে থাকা যাত্রীদের ভাষ্য, রানওয়েতে নামার পর যখন পাইলট শামীম নজরুল নিয়ন্ত্রণ হারাতে যাচ্ছিলেন তখন বুদ্ধি খাটিয়ে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেন। এতে উড়োজাহাজের সব ধরণের বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আগুন লাগেনি। যাত্রীরা বলছেন পাইলটের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তার কারণে সব যাত্রী বেঁচে গেছেন। তিনি নিজেও এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।
ক্যাপ্টেন শামীমকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা। কিন্তু যে ঘটনা হতাশ করেছে সেটি হলো, ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটি এর আগেও দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়। এ পর্যন্ত একাধিকবার বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে উড়োজাহাজটি। প্রশ্ন হলো, তাহলে এই মানের উড়োজাহাজ কেন থাকতে হবে বিমানের বহরে?
খবর পড়েই জানলাম, ২০১৫ সালে এপ্রিলে মিশরের স্মার্ট এভিয়েশন থেকে ইজারা নেওয়া হয় এ উড়োজাহাজটি। আট বছর দুই মাস বয়সী এ উড়োজাহাজ অপারেশনের উপযোগী না হলেও, প্রতিদিন নাকি চার-পাঁচটি রুটে চালানো হতো। দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজটি গত ৬ মার্চ হায়দরাবাদ থেকে বড় ধরনের মেরামত যাকে প্রযুক্তির ভাষায় বলে সি-চেক সেটি শেষ করে দেশে আসার পথেই ইঞ্জিনের ওপরে থাকা ব্ল্যাঙ্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে ইঞ্জিন অস্বাভাবিক উত্তপ্ত হয়ে পড়ে এবং ইঞ্জিন অয়েল বিপজ্জনক মাত্রায় চলে আসে। তখন আকাশেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু অল্পের জন্য রক্ষা পায়। ওই ঘটনার দুই মাস পর ঘটলো মিয়ানমারের দুর্ঘটনা। তবে এবার যেভাবে তিন টুকরো হয়ে গেছে তাতে উড়োজাহাজটি বিমান বহরে আর যুক্ত হতে পারবে বলে মনে হয় না।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হককে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যম বলছে, হায়দরাবাদ থেকে সি-চেক সেরে দেশে ফেরার পথে আকাশে বিকল হওয়া উড়োজাহাজ কেন অপারেশনে রাখা হচ্ছে- তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে পরিস্থিতি বুঝে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি করা হবে। আগামীতে বিমানবহরে লিজের নামে নিম্নমানের উড়োজাহাজ যোগ করা বন্ধ করব।
যেহেতু বিশেষজ্ঞ নই, কাজেই বলতে পারবো না বিজি-০৬০ ফ্লাইটের ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজটির মান কেমন ছিল। প্রত্যাশা করি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চিফ অব ফ্লাইট সেফটি শোয়েব চৌধুরীকে প্রধান করে ছয় সদস্যের যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে তারা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখুক। কারণ বিমানের বহরে যে তিনটি ড্যাশ-৮ রয়েছে সেগুলো আগেও নানা সময় দুর্ঘটনায় পড়েছে। কপাল ভালো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
অনুপযোগী উড়োজাহাজ চালানো অব্যাহত রাখলে, কপাল কতদিন ভালো থাকবে? পাইলটরাই বা তাদের দক্ষতায় কতদিন রক্ষা করতে পারবেন? ভাবার সময় আরও বহু আগেই এসেছে। কর্তৃপক্ষ তা ভাবছেন যে না, বোঝা যাচ্ছে। এখন কী মানুষের জীবন, নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারসাইনসের কর্তারা তা ভেবে দেখবেন?
লেখক: কলামিস্ট
প্রোগ্রাম প্রধান, মাইগ্রেশন, ব্র্যাক
Comments