‘সংখ্যা’ দিয়ে রাজনীতি হয়, ক্ষুধা তাড়ানো যায় না

Development and poverty
ছবি: স্টার

দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, মাথাপিছু আর বাড়ছে, জিডিপি বাড়ছে, প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান বাড়ছে- সবই সত্যি। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল সারাবিশ্বের কাছে এমনটিই দাবি সরকারের। কিন্তু, একটি কথা কেউ বলছেন না, দেশে যে হারে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে সে হারে কি দারিদ্র কমেছে? কিংবা ধনী গরিবের পার্থক্য কি কমেছে? আসুন দেখি তথ্য উপাত্ত পরিসংখ্যান কি বলে?

স্বাধীনতা পরবর্তী যে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিলো মাত্র ৭০ ডলার, ২০১৯-এর বাংলাদেশে তা ১,৯০০ ডলার ছাড়িয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকেও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিবেদন অনুযায়ী বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের স্থান ১৩৬তম। গত ১১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছ। যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতির একটি। বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে তার অবস্থান দ্বিতীয়।

নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে- আরও বহু সূচকেই আমাদের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো।

এতো গেলো মুদ্রার এপিঠের গল্প। কিন্তু, মুদ্রার উল্টো পিঠের গল্পও আছে। সাফল্যর খবর মিডিয়াতে যতোটা চাউর, ব্যর্থতার গল্পে ততটাই নীরব।

গতবছরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি’ বা ‘দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার ২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের পাঁচটি দেশেই পৃথিবীর মোট গরীবের অর্ধেক গরিব লোক বাস করে। এ দেশগুলো হলো ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া এবং বাংলাদেশ। ক্রয় ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) যাদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম তাদের হতদরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাবিশ্বে এমন দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৭৩ কোটি ৬০ লাখ। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১ কোটি ৬২ লাখ হতদরিদ্র।

এর বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম।

তার কিছুদিন পরেই বিশ্বব্যাংক আরেক প্রতিবেদনে বলেছে ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ছে বেকারত্বের হার। গত বছর নভেম্বরের দিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত সাত বছরে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলও-এর ‘এশিয়া প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক ২০১৮’-এ উল্লেখ করা হয় ১৫-২৫ বছর বয়সী যুবসমাজের বেকারত্বের হার ২০১৭ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০০ সালে এই হার ছিলো ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। চাকরি, লেখাপড়া কিংবা প্রশিক্ষণে সংশ্লিষ্ট নন, এমন যুবকদের বেকারত্বের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

তার মানে সহজ কথায় দাঁড়ালো সমাজের এক শ্রেণির লোকের হাতে যেমন অজস্র টাকা, ঠিক তেমনি আরেক শ্রেণি ভীষণ গরীব। সংখ্যার হিসাব দিলাম, কারণ সবাই পরিসংখ্যান চান। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, তাই অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না। সাধারণ মানুষও অর্থনীতির প্রতি কতোটা আগ্রহী, পরিসংখ্যানে কতোটা বিশ্বাসী- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মানুষ পরিসংখ্যান চায় না, চায় চাকরি, চায় খাবারের নিশ্চয়তা, চায় নিরাপত্তা।

সবাই সংখ্যার খেলা খেলতে চান, কারণ সংখ্যা নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়া যায়। সংখ্যা দিয়ে রাজনীতিটা খুব ভালো হয়, পরিবেশনাটা খুব চমৎকার হয়। কিন্তু, সংখ্যা দিয়ে ক্ষুধা তাড়ানো যায় না। সংখ্যা দিয়ে বেকার যুবকের কষ্ট লাঘব হয় না।

বাস্তবতা হচ্ছে, উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর অন্যতম কারণ। দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটের কারণে ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং গরিব হচ্ছে আরও গরিব।

উন্নয়নের হিসাব মিলাতে মিলাতে একটি ফেসবুক স্ট্যটাসে মনটা বেশ ভারী হয়ে উঠলো। তিন মাস চাকরি নেই, বাচ্চার জন্য দুধ চুরি করে ধরা খেলেন বাবা। তার চাকরি নেই ৩ মাস, চুরি ছাড়া বাচ্চার দুধের আর কোনো ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না। আমিও এক সন্তানের বাবা, সন্তানের জন্য বাবা পারে না এমন কোনো কাজ পৃথিবীতে নেই, তা সে কাজ যতোই নিন্দনীয় হোক।

এই যে এতো উন্নয়ন চারদিকে হচ্ছে, এই উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও কি এই বাবা পাননি? এমন কতো বাবা রয়েছেন এদেশে? জানি না, তবে মনে প্রাণে চাই যেনো না থাকেন।

এরই মাঝে খবরে দেখলাম ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে ৬০ জনের মৃত্যু- যার মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি। দেশ যখন নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ে পৌঁছায়, তখন কিসের আশায়, কিসের নেশায় মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ে? কেনো বেঘোরে প্রাণ দেয়?

সব মিলিয়ে মনটা খুবই বিষণ্ণ। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ইতালির পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘দি বাইসাইকেল থিফ’। এক দরিদ্র পিতা সন্তানের আবদার মেটাতে সাইকেল চুরি করে গণপিটুনি শিকার হয়েছিলেন। তার সন্তানের সেকি চাহনি। এতো করুন চাহনি আমি আর দেখিনি, দেখতেও চাই না, কারণ আমি কাঁদতে চাই না।

উন্নয়ন চাই। তার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু, উন্নয়নের নামে সংখ্যার রাজনীতি দেখতে চাই না। বাবা সন্তানের জন্য দুধ চুরি করবেন বা কর্মসংস্থানের আশায় অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সময় ডুবে মরবেন- এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না।

মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা, সাংবাদিক

[email protected]

 

এই লেখকের আরও লেখা

‘দিন যায় কথা থাকে’

জিপিএ-৫ আসক্তি ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ

ঋণখেলাপি হবো- এটাই আমার অ্যাম্বিশন

একজন অ্যাসাঞ্জ ও মুক্ত সাংবাদিকতা

‘মুকুটটা তো পড়েই আছে, রাজাই শুধু নেই'

শান্তি তবে কোথায়?

গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায় না অমুসলিম সন্ত্রাসীদের হামলার খবর

যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছরে ৭১ শতাংশ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে শ্বেতাঙ্গরা

Comments

The Daily Star  | English

SC orders EC to restore Jamaat's registration

The Appellate Division of the SC scrapped a High Court verdict that had declared Jamaat's registration with the EC as a political party "illegal"

54m ago