পদ্মা নদী দখল করে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি!

রাজশাহীর শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মা নদীর একশ একর জমি অধিগ্রহণ করছে কারা কর্তৃপক্ষ। শহররক্ষা বাঁধের পাশে এবং পদ্মা নদীর মধ্যে এই জমিতে নির্মাণ করা হবে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি কমপ্লেক্সের একটি অংশ।
রাজশাহীতে পদ্মা নদীর চরে কারা কর্তৃপক্ষের সাইনবোর্ড। ছবি: আনোয়ার আলী

রাজশাহীর শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মা নদীর একশ একর জমি অধিগ্রহণ করছে কারা কর্তৃপক্ষ। শহররক্ষা বাঁধের পাশে এবং পদ্মা নদীর মধ্যে এই জমিতে নির্মাণ করা হবে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি কমপ্লেক্সের একটি অংশ।

নদীর মধ্যে ওই এলাকায় ইতিমধ্যেই কারাগার কর্তৃপক্ষ চার একর জমির মালিকানা দাবী করে দখল করে নিয়েছে। যদিও দেশের আইন বলছে নদীতে জেগে ওঠা চরের মালিক সরকার।

গত এপ্রিলের শেষে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের রোপিত বনের ৫৬১টি গাছ কাটা শুরু করেছিলো। প্রায় ৬৬টি গাছ কাটার পর স্থানীয়দের আন্দোলনের মুখে গাছ কাটা বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়রা বলেছেন, এ বনের অনেক গাছই শত বৎসরের ঐতিহ্য বহন করছে ও নানা প্রজাতির পাখীর আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

শ্রীরামপুরের যে জায়গাটিতে গাছগুলো কাটা চলছিলো তার বিপরীত দিকে পদ্মা নদীর ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারা কর্মকর্তাদের বক্তব্য- তারা গত বছর মে মাসে আবেদন করেছে এবং বর্তমানে আবেদনটি অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

ভূমিমন্ত্রণালয়ের উপসচিব সেবাস্তিন রেমা গত ১২ মে বলেন, তারা এ ধরণের কোনো প্রস্তাব এখনো হাতে পাননি।

কিন্তু, এই সংবাদদাতা কিছু অফিসিয়াল নথি দেখেছেন যেখানে কারা কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয় থেকে জমি চেয়ে আবেদন করেছেন এবং সেই জমিকে ‘নতুন জেগে উঠা চর’ হিসেবে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্ষার বন্যায় এখনো ঐ এলাকা প্লাবিত হয়, আবার বর্ষা পেরোলে চর জেগে ওঠে। চর জেগে উঠলে স্থানীয়রা আগে সেখানে ফসলের চাষ করতেন এবং অন্যেরা মুক্ত এলাকায় সময় কাটাতেন বা হাঁটতেন।

কারাগারসূহের উপ-মহাপরিদর্শক আলতাব হোসেন বলেন, “অন্য এলাকায় পছন্দমত জায়গা না পাওয়ার কারণে আমাদেরকে নদীর জায়গাটি নির্বাচন করতে হয়েছে।” রাজশাহীতে তার কার্যালয়ে বসে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা চেয়েছিলেন যে কারা একাডেমিটি যেনো নদীর পাশেই কোনো স্থানে হয়, যাতে করে প্রশিক্ষণের উপযোগী পরিবেশ বজায় থাকে।

তিনি জানান, চরের জমিটি পেলে তারা সেখানে শরীরচর্চা, খেলাধুলাসহ নানান প্রশিক্ষণের জন্য অবকাঠামো গড়বেন। তার মতে, একাডেমির কাজ নদীর জমিতে করতে হলে তাদেরকে নদী ভরাট ও নদী শাসনের মতো কর্মসূচিও হাতে নিতে হবে যাতে করে বন্যায় এলাকাটি প্লাবিত না হয়।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বলেন, “রাজশাহীতে এসেই আমি দেখলাম যে এখানে পদ্মা নদীর জমি ব্যক্তি মালিকানায় দাবী আছে। দেশের অন্য প্রান্তে এমনটা দেখা যায় না।”

তার বক্তব্য, সরকার চাইলে নদীর জমি বন্দোবস্ত দিতে পারে। তবে পদ্মা নদীর জমি কারা কর্তৃপক্ষ বন্দোবস্ত চেয়েছে কী না তা তার জানা নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেন, “আমার কাছে এরকম আবেদন নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আসেননি।” তিনি জানান, কতোটুকু জমি কারা কর্তৃপক্ষের নামে আছে আর কতোটুকু তারা দখল করে রেখেছেন তাও কখনো খতিয়ে দেখা হয়নি।

রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব আলমগীর কবির বলেন, বাংলাদেশ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০ অনুযায়ী নদী বা সমুদ্র গর্ভ থেকে কোনো চর জেগে উঠলে তার মালিক হবে সরকার।

তিনি জানান, রিভিশনাল সার্ভে অনুযায়ী পদ্মা নদীর ওই স্থানে প্রায় ২ দশমিক ৮ একর জমি কারা কর্তৃপক্ষের নামে পাওয়া যায়, তবে উপরোক্ত আইন অনুযায়ী জমিটির মালিক সরকারই হবে।

কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ও তাদের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫ সালে যখন কারা প্রশিক্ষণ একাডেমিটি রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তার আগে দেশে কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের প্রশিক্ষণের কোনো জায়গা ছিলো না। দীর্ঘদিন ধরে ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তাদের চেষ্টায় একাডেমিটি ২০১৪ সালের আগস্টে সরকারি অনুমোদন লাভ করে।

rajshahi prison
এটি পদ্মার চর। এখানে কারা কর্তৃপক্ষ কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণ করতে চাচ্ছে। ছবি: আনোয়ার আলী

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জমিতে একাডেমির কার্যক্রম চলে আসছে। জেলখানার ভিতরেই তিন-রুমের একটি পুরনো একতলা ভবন ছিলো যেখানে একাডেমির কম্যান্ডান্টের কার্যালয় করা হয়েছিলো। তিনটি টিনশেডে পুরুষ ও মহিলা প্রশিক্ষণার্থীরা থাকেন এবং তাদের ক্লাস করার জন্য ব্যবহার করা হতো আরেকটি টিনশেড ভবন।

একাডেমিতে শারীরিক, তত্ত্বীয়, অস্ত্র ও অস্ত্রহীন যুদ্ধের নানান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ পর্যন্ত সেখানে জেল সুপারদের ছয়টি ব্যাচ, ডেপুটি জেলারদের ১০টি ব্যাচ এবং পুরুষ ও মহিলা কারারক্ষীদের ৪২টি ব্যাচের বিভিন্ন মেয়াদী মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্থানাভাব ও অবকাঠামোর অভাবে সব প্রশিক্ষণ রাজশাহীতে করা সম্ভব হয় না। যেমন, ২০১৬ সালে একাডেমির ৩৫০ এর বেশি কারারক্ষীদের ছয়মাসব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করতে হয়েছিলো গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার ক্যাম্পাসে।

পরে ২০১৫ সালের জুনে একনেকের সভায় একাডেমির ভৌত অবকাঠামোগুলো তৈরির জন্য ৭৩ কোটি ৪২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।

এ প্রকল্প অনুযায়ী রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জমিতেই একাডেমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কারাগারের নিজস্ব হিসাব মতে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের মোট জমির পরিমাণ ৬৫ দশমিক ৪০৭০ একর। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৮৮১৯ একরের উপর রয়েছে কারাগারটি। বাকি ৪৬ দশমিক ৫২৫১ একর জমির মধ্যে, একাডেমির জন্য বরাদ্দ করা হয় ৩৭ দশমিক ১৩৩৫ একর।

২০১৬ সালে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজগুলো ১২টি প্যাকেজে ভাগ করে তা শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। একাডেমির প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ব্লক, প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন, কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবাসভবন ও মেস নির্মাণের কাজ এ বছরেই শেষ হওয়ার কথা। বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা এবং বৃক্ষরোপণের কাজ টেন্ডার আহবানের পর্যায়ে রয়েছে।

কারাগারের মোট জমিতে বহু বছর ধরে রোপিত গাছের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে একাডেমি নির্মাণের জন্য প্রায় ৮০০ গাছ কেটে ফেলার প্রয়োজন হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৬১টি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। বন বিভাগ গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণ করেছিলো ১১ লাখ টাকা। তবে টেন্ডার আহ্বান করার পর চারজন সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ৫৬১টি গাছ ১৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। গাছগুলোর মধ্যে শত বছরের ঐতিহ্যের গাছ ছিলো অনেকগুলো- যেগুলোতে অগুনতি পাখি বাসা বেঁধেছিলো। প্রায় ৬৬টি গাছ কাটার পর স্থানীয়রা বিক্ষোভ শুরু করলে গত ২৯ এপ্রিল কর্তৃপক্ষ গাছ কাটা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় যে পুরনো এবং ফলদায়ক গাছগুলি আর কাটা হবে না।

প্রকল্পটির কাজ শুরুর সময়েই পদ্মা নদীর ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়, তবে পূর্ণাঙ্গ আবেদনটি করা হয় গত বছর।

শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মাপারে পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, ঠিক যেখানে কাটা গাছগুলি পড়ে আছে তার বিপরীত দিকে শহর রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উপর কারা কর্তৃপক্ষ একাডেমির নামে ছয়টি সাইনবোর্ড বসিয়েছে। এগুলোর কোনোটিতে লেখা আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প অনুমোদন ক্রমে কারা একাডেমির জন্য নির্ধারিত স্থান। কোনোটিতে লেখা রয়েছে, সংরক্ষিত এলাকা, সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কোনোটিতে রয়েছে জমির বিবরণ।

বাঁধের নিচে, দক্ষিণে নদীর দিকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাঁশের খুঁটি পুঁতে কারাগারের জমির সীমানা নির্ধারণ করে রাখা আছে। খুঁটিগুলোতে লাল, হলুদ পতাকা টাঙানো। সীমানার মাঝ বরাবর নদীর মধ্যে একটি টিনশেড নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেখানে দুজন কারারক্ষী পাহারায় নিয়োজিত আছেন।

কারারক্ষীদের একজন জানালেন যে তারা জমি পাহারা দিচ্ছেন। তারা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পালা করে প্রতি ছয় ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ষায় যখন এলাকাটি প্লাবিত হয়, তখন তারা বাঁধের উপর উঠে যান।

আরেকজন কারারক্ষী জানালেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে তারা এই ধরনের পাহারা দিচ্ছেন।

“আপনি তো আপনার নিজের জমি নিজের দখলেই রাখবেন,” বলেন কারা উপ-মহাপরিদর্শক আলতাব হোসেন। তার দাবি, নদীর চার একর জমি তাদের নামে থাকার রেকর্ড রয়েছে। তিনি জানান, তারা আরও ১০০ একর জমি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানাতে অস্বীকার করেন।

আনোয়ার আলী, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

Comments