৫৭ ও ৩২ ধারার আদলে এবার জাবি’র শিক্ষার্থী শৃঙ্খলা বিধি!

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী শৃঙ্খলা বিধি হালনাগাদ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই শৃঙ্খলা বিধির দুটি ধারা ক্যাম্পাসের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ এটিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারা ও নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার অনুকরণ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
ju main gate
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। ফাইল ছবি

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী শৃঙ্খলা বিধি হালনাগাদ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই শৃঙ্খলা বিধির দুটি ধারা ক্যাম্পাসের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ এটিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারা ও নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার অনুকরণ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।

হালনাগাদকৃত শৃঙ্খলা বিধির যে ধারাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে- “কোনো ছাত্র/ছাত্রী অসত্য এবং তথ্য বিকৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোনো সংবাদ বা প্রতিবেদন স্থানীয়/জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা বা উক্ত কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।” শৃঙ্খলা বিধিতে ৫-এর ঞ নম্বর ধারা হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে এটি।

ধারাটি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, কোনটি অসত্য কিংবা বিকৃত তথ্য তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা যেহেতু প্রশাসনের হাতে ফলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোনো তথ্য বা প্রতিবেদনকেই প্রশাসন অসত্য বলে চিহ্নিত করতে পারবে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে এটা একটা অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে।

অপরটি ৫-এর (থ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উদ্দেশে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ইন্টানেটের মাধ্যমে কোনও অশ্লীল বার্তা বা অসৌজন্যমূলক বার্তা প্রেরণ অথবা উত্ত্যক্ত করবে না।”

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখানেও সমস্যার বিষয় হচ্ছে প্রশাসন যেকোনো যৌক্তিক দাবি বা ক্ষোভকে অসৌজন্যমূলক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা রাখবে। যেহেতু এখানে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বলে দেওয়া নেই। ফলে এটিরও অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকবে।

গত ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন পেয়েছে ধারা দুটি। জানাজানি হওয়ার পর এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, ধারা দুটি স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চাকে রুদ্ধ করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে।

সংশোধিত বিধিতে ধারা দুটি লঙ্ঘণ করার শাস্তির কথা বলা হয়েছে- লঘু শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, সতর্কীকরণ এবং গুরু শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার, বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার ও পাঁচ হাজার টাকার উর্ধ্বে যেকোনো পরিমাণ জরিমানা করা হবে।

দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, “এখানে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিধ্বনি দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব নিবর্তনমূলক তৎপরতা রয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিব্যক্তিকে এটা সংকুচিত করবে। যেহেতু প্রশাসন তাদের মতো করেই সত্য-অসত্য প্রতিপাদন করবে। ফলে এটার অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।”

বিশ্ববিদ্যালযের সিনেট সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, “শিক্ষার্থীদের আচরণবিধি অংশে উল্লিখিত ৫(ঞ) এবং ৫(থ) উপধারা দুটি বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা) এবং অনুচ্ছেদ ৪০ (পেশা বৃত্তির স্বাধীনতা) এর পরিপন্থি।”

তিনি আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার বিকাশ এবং লালন-পালনের যথাযথ স্থান। এই উপধারা দুটি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীতি ও শঙ্কা তৈরি করবে, যা শুভ নয়। ক্যাম্পাসে কর্মরত সংবাদকর্মীদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করবে এবং সাংবাদিকরা নিগ্রহের শিকার হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি যেখানে ঢালাওভাবে উপধারায় উল্লিখিত কর্মকাণ্ড সংঘঠিত হতে পারে। উপরন্তু, অসত্য, তথ্য বিকৃতি, আশালীন বার্তা বা অসৌজন্যতামুলক বার্তার কোনো সংজ্ঞা কিংবা ব্যাখ্যা না থাকার ফলে উপধারা দুটি নিপীড়নমূলক হয়ে উঠতে পারে এবং উঠবে এটাই স্বাভাবিক।”

এছাড়াও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অসত্য কিংবা বিকৃত তথ্য প্রকাশ বা ছড়ানোর বিষয়ে যথাযথ আইন রয়েছে। সেগুলো তদন্তের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এধরনের অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে অস্পষ্ট ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে দোষী সাব্যস্ত করার এখতিয়ার রাখে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্বববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, “এই উপ-ধারা দুটি তিনটি মুল স্পিরিটের পরিপন্থি। প্রথমত, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ স্পিরিটের পরিপন্থি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে শেখায়, গঠনমূলক সমালোচনা করতে শেখায়। দ্বিতীয়ত, ৭৩’র অধ্যাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার সাথে এটি সাংঘর্ষিক। তৃতীয়ত, এটি মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার পরিপন্থি।”

“বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ক্যাম্পাস সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে তাহলে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ নষ্ট হবে” এবং “কেউ সত্য তথ্য তুলে ধরতে পারবে না” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাকিব আহমেদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো সাংবাদিককে শাস্তি দিতে পারে না। যদি কেউ ‘মিথ্যা’ কিংবা ‘বিকৃত’ তথ্যে প্রকাশ করেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত প্রচলিত আইনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো।”

“যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক কোনো প্রতিবেদন লেখেন, তখন তিনি সাংবাদিক হিসেবেই লেখেন, শিক্ষার্থী হিসেবে নন।” এছাড়া, তিনি শিক্ষার্থীদের ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের কথাটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

জাবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ দিদার এটিকে ‘দূরভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে অভিহিত করেন যা শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে চেপে ধরতে সাহায্য করবে।

জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এই দুটি উপধারাকে ‘কালাআইন’ বলেছেন।

কোনটি ‘মিথ্যা’ কিংবা ‘বিকৃত’ তথ্য এটি কে নির্ধারণ করবেন?- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ. স. ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, “এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। যেখানে সকল ডিন, প্রভোস্ট ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন।”

জাবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মাহমুদ উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, “ধারা দুটি সংযোজন করে প্রশাসন কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার জানান দিচ্ছে। এটা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার গণমাধ্যমকর্মী ও প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের থামিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মহান প্রতিষ্ঠানে এমন নিবর্তনমূলক নীতিমাল লজ্জাকর। প্রশাসনকে অবশ্যই এটি বাতিল করতে হবে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য় অসুস্থ। ফলে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নুরুল আলম বলেন, “আমরা কখনই বলিনি যে আমরা সাংবাদিকদের শাস্তির আওতায় আনবো। এটি নিয়ে কারও আপত্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান হতে পারে।”

মো. আসাদুজ্জামান, দ্য ডেইলি স্টারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

Comments

The Daily Star  | English

Abu Sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago