ওয়ানডে ক্রিকেট ও বিশ্বকাপ শুরুর ইতিকথা

১৪২ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ৪২২টি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। তার মধ্যে একটি টেস্ট ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে যে ম্যাচে একটি বলও মাঠে গড়ায়নি। আর সে পরিত্যক্ত টেস্ট ম্যাচটিই গড়ে তোলে নতুন এক ইতিহাস। মেলবোর্নের সে ম্যাচ থেকেই যে তৈরি হয় ওয়ানডে ক্রিকেট। যার ধারাবাহিকতায় চার বছর পর বিশ্বকাপ। সে ম্যাচটি পরিত্যক্ত না হলে হয়তো এখনও বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনই সম্ভব হতো না।
ছবি: আইসিসি

১৪২ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ৪২২টি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। তার মধ্যে একটি টেস্ট ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে যে ম্যাচে একটি বলও মাঠে গড়ায়নি। আর সে পরিত্যক্ত টেস্ট ম্যাচটিই গড়ে তোলে নতুন এক ইতিহাস। মেলবোর্নের সে ম্যাচ থেকেই যে তৈরি হয় ওয়ানডে ক্রিকেট। যার ধারাবাহিকতায় চার বছর পর বিশ্বকাপ। সে ম্যাচটি পরিত্যক্ত না হলে হয়তো এখনও বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনই সম্ভব হতো না।

কারণ এর আগে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়াতে একটি বিশ্বকাপ আয়োজনের অনেক চেষ্টাই করেছে আইসিসি। ১৮৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার প্রথম টেস্ট খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় দুই যুগ পর ১৯০০ সালে অলিম্পিকে ক্রিকেটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে আসরে গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স অংশ নেয়। ফরাসীদের ১৫৮ রানে হারিয়ে স্বর্ণপদক জিতে নেয় ব্রিটেন। কিন্তু এক আসর না যেতেই ক্রিকেটকে বাদ দেয় অলিম্পিক কমিটি। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা চিন্তায় পড়ে যায়। খেলাটিকে বৈশ্বিক করতে একটি জমজমাট আসর যে চাই।

সে ভাবনা থেকে ১৯১২ সালে ওই সময়ের তিনটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ত্রি-দেশীয় প্রতিযোগিতা আয়োজনের প্রথম প্রচেষ্টাও চালানো হয়। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়া ও দর্শকদের অনাগ্রহে মুখ থুবরে পড়ে সে আসর। তখন থেকেই টেস্ট ক্রিকেট দ্বিপাক্ষিক সিরিজে পরিণত হয়। তখন আইসিসি যেন একটু ব্যাকফুটে চলে যায়।

ওইদিকে ফুটবল, আইস হকি এমনকি টেবিল টেনিসের বিশ্বকাপেরও তখন রমরমা অবস্থা। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, রাগবি ও ভলিবলও বিশ্বকাপ আয়োজন শুরু করে। পড়ে থাকে অভিজাত খেলা ক্রিকেট। কালক্রমে নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও পাকিস্তানও যোগ হয় টেস্ট আঙিনায়। টাইমলেস যুগ থেকে পাঁচ দিনের জামানায় যাত্রা করে খেলাটি। তারপরও একটি ম্যাচ পাঁচ দিনের হলেও তো বিশ্বকাপ আয়োজনে লেগে যাবে লম্বা সময়।

সব সমস্যার সমাধান করে দেয় মেলবোর্নের সেই পরিত্যক্ত ম্যাচটি। ১৯৭১ সালে ১ জানুয়ারি শুরু হওয়ার কথা ছিল সে টেস্ট ম্যাচটি। কিন্তু ম্যাচের প্রথম চার দিনই টানা বৃষ্টিতে একটি বল মাঠে গড়ানো সম্ভব হয়নি। বিস্ময়কর ভাবে পঞ্চম দিনে ঝকঝকে রোদ ওঠে। মজার ব্যাপার সে দিনও স্টেডিয়ামের গ্যালারি পরিপূর্ণ। অথচ সেদিন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। কনকনে শীতেও প্রিয় দলের খেলা দেখতে উপস্থিত সমর্থকরা। তার উপর এর আগের দুটি টেস্টই যে ড্র হয়েছে। আগ্রহটা অনেক।

এদিকে দোটানায় পড়ে যায় মেলবোর্ন কর্তৃপক্ষ। একদিনে টেস্ট ম্যাচ শেষ হওয়া যে কোনভাবেই সম্ভব না। আর এ টেস্ট ড্র হলে একটি অতিরিক্ত ম্যাচ আয়োজন করতে গচ্চা দিতে হবে ৮০ হাজার পাউন্ড। কারণ ইংল্যান্ডকে নিজ দেশে রাখতে খরচ ছাড়াও তাদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে। এছাড়া শিডিউল করা টেস্ট শেষ হতেই সময় লাগবে ৪০ দিন। অন্যদিকে ৪৮ দিনের মধ্যে পাকিস্তানও আসছিল অস্ট্রেলিয়া সফরে। আর আগের দুই টেস্ট ড্র হওয়ায় দর্শকরাও হতাশ ও উত্তেজিত।

স্বল্প সময়ে সমর্থকদের দেখার মতো কিছু তো দিতে হবে! অবশেষে ইংল্যান্ড একাদশ ও অস্ট্রেলিয়া একাদশ নামে একটি একদিনের সীমিত ওভারের ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ৪০ ওভারে ম্যাচটি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কারণ তখন ৮ বলে ওভার হতো। শেষ মুহূর্তে সিগারেট কোম্পানি রথম্যান্স ম্যাচটির পৃষ্ঠপোষকতা করে। ৫০০০ পাউন্ড দেয় ম্যাচটি আয়োজনের জন্য এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচের জন্য ৯০ পাউন্ড।

ঐতিহাসিক সে ম্যাচটি ৪২ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটে জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। তবে সে ম্যাচের আবহ নিয়ে অধিনায়ক রায় ইলিংওয়ার্থ ১৯৯৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমি অনেক ক্ষণ ধরে ড্রেসিং রুমে অপেক্ষা করি। শেষ পর্যন্ত খেলতে পেরেই কৃতজ্ঞ ছিলাম। এটা শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আয়োজিত হয়েছিল। আমি বলতে পারব না, আমি নিজের সেরাটা দিয়ে খেলেছি কি না।'

অনেকটা মজার ছলেই প্রথম ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেছিলেন ক্রিকেটাররা। ইংলিশ অফস্পিনার অ্যাশলে মাল্লেট বলেছিলেন, 'তারা সেটাকে প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ বলে সেটা আমাকে অনেক বছর বিস্মিত করেছে। এখন ভাবি, আমিও এই ইতিহাসের অংশ। কিন্তু এক সময় এটাকে আমি স্রেফ কৌতুক হিসেবেই মনে করতাম।'

তবে ইতিহাস যে গড়ে ফেলেছেন তার উত্তরসূরিরা তা বুঝতে পেরেছিলেন সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। সে ম্যাচের আগে অসি দলের সব খেলোয়াড়দের একত্রিত করে একটি বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সব শেষে দর্শকদের দেখিয়ে বলেছিলেন, 'তোমরা দেখতে পাচ্ছ, একটা ইতিহাস তৈরি হতে যাচ্ছে।'

সে ম্যাচে দিনের শুরুতে স্টেডিয়ামে ছিল উপস্থিত ছিল ২০ হাজার দর্শক। ম্যাচের সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে তা পরিণত হয় ৪৬ হাজার ৬ জনে। সে ধারায় এ সফলতা ও জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঘরোয়া ভিত্তিতে একদিনের প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসি আবার নড়েচড়ে বসে। ১৯৭৫ সালে আয়োজন করে ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম আসর।

তবে তখনও ঠিকভাবে হাঁটা শিখতে পারেনি ওয়ানডে ক্রিকেট। বিশ্বকাপের আগে মোটে ওয়ানডে ম্যাচ হয়েছে ১৮টি। যে আট দল নিয়ে আয়োজিত হয় বিশ্বকাপ, তাদের মধ্যে বেশ কিছু দলের এ সংস্করণে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল শূন্যের কোটায়। তখন ক্রিকেটের সবকিছুই ইংল্যান্ড কেন্দ্রিক। তাই স্বাগতিক দেশ বাছাই করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি আয়োজকদের। ইংল্যান্ডের ৬টি ভেন্যুতে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন শুরু হয় বিশ্বকাপ। আসরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রুডেন্সিয়াল অ্যাসিউরেন্স কোম্পানির নামে নামকরণ করা হয় প্রুডেন্সিয়াল কাপ! আর প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় ক্লাইভ লয়েডের প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago