নজরুলের বিদ্রোহ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে

ভারতের নির্বাচনে যখন বিজেপি আবার বিপুল বিক্রমে ক্ষমতায় আসছে, ঠিক সেই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে।
kazi nazrul islam
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। স্টার ফাইল ছবি

ভারতের নির্বাচনে যখন বিজেপি আবার বিপুল বিক্রমে ক্ষমতায় আসছে, ঠিক সেই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে।

কী বৈপরীত্য। অসাম্প্রদায়িক নজরুলের জন্মস্থানে সাম্প্রদায়িকতার জয়জয়কার। এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মে কবি কীভাবে মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠলেন সে আলোচনা আজ জরুরি। যার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিলো মাদ্রাসায় এবং যে জীবনের তাগিদে মুয়াজ্জিনের কাজও করেছেন সেই ব্যক্তি আবার কী করে বলেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।”

স্বাধীনচেতা নজরুলের সংগ্রাম জীবনী বাংলা ভাষাভাষী সবারই কম বেশি জানা আছে। তার জন্মক্ষণটি ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা পরবর্তীকালে কবি মানসে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন ঘটে।

কবির বেড়ে ওঠার সময়ে বিশ্বে রাজনীতিতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটছিলো। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন। যার কারণে কবিকে আমরা কখনও বিদ্রোহী, কখনও সংস্কারবাদী, কখনও প্রেমিক পুরুষ, কখনও নবীর শান গাইতে কখনও বা শ্যামা সংগীত গাইতে দেখি।

কবির বেড়ে ওঠার সময় কবি বারবার প্রত্যক্ষ করেছেন সাম্প্রদায়িক বিভেদের কলুষিত রূপ। দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কবি মনে তা গভীর রেখাপাত করেছিলো, যার কারণে তিনি বারবার চেয়েছেন মানুষের মুক্তি। তাই প্রলয় শিখায় কবি লিখেছিলেন:

“ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ

ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,

এক মানবের একই রক্ত মেশা

কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”

নজরুলের সারা জীবনের সংগ্রাম ছিলো ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে। তিনি বারবার তার কবিতায়, গানে, গল্পে লিখে গেছেন যে ধর্মীয় শক্তি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে বা পরস্পরের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, তা ধর্ম নয় অধর্ম। সংগ্রাম করেছেন সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে। তিনি মনে করতেন অসাম্প্রদায়িকতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করা।

কবি তাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাধ্যমে বারংবার মানবধর্মের কথাই বলেছেন। তিনি বারবার বলেছেন মানবধর্মের উপরে কিছু নেই। তাই লিখেছেন:

“মানুষেরে ঘৃণা করি

ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!

ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে

যাহারা আনিল গ্রন্থ-কিতাব সেই মানুষেরে মেরে।

পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! -মূর্খরা সব শোনো,

মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”

নজরুল জন্মসূত্রে ভারতীয়, ধর্মে মুসলিম। দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যেই তার বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠা। ছোটবেলায় মুয়াজ্জিনের কাজ আর মক্তবে পড়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যেমন জেনেছেন আবার ঠিক তেমনি যখন লেটো গানের দলে যোগ দিলেন তখন শিখলেন জানলেন রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত আর পুরাণ।

দুটো ধর্মকেই মোটামুটি নিবিড়ভাবে জানতে পেরেছিলেন বলেই তিনি এক হাত দিয়ে লিখতে পারতেন গজল আর ইসলামি গান, আবার ঐ একই হাতে লিখতেন শ্যামা সঙ্গীত, ভজন আর কীর্তন অঙ্গের গান। পরবর্তীতে তিনি যখন প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন তখন তিনি হিন্দু ধর্মের আরও খুঁটিনাটি বিষয় জানতে পারেন। যে কারণে তার গানে আমরা বিভিন্ন মিথের ব্যবহার দেখতে পাই, গোপ-গোপিনীর প্রেমের কথা জানতে পারি।

নজরুলের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং করাচীতে বসবাস এবং সেই সূত্রে ওমর খৈয়াম ও রুমির সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচয় তার জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। আবার করাচী থেকে ফেরার পরে কলকাতাতে কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সাহচর্য তাকে মানবধর্মের এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।

তাই তিনি ঐ সময়ে সাহসী উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন:

“তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।

মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’

কোথা চেঙ্গিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?

ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার!

খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?

সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!

হায়রে ভজনালয়,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!”

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক গান বা কবিতার কারণে সবসময় তিনি ছিলেন ধর্মান্ধদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়েছেন তার সৃষ্টিতে দেব-দেবীদের আরাধনা দেখে, আবার সনাতনীরা খেপেছেন যখন তিনি বলেছেন “আমি বিদ্রোহী ভৃত্য, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।”

এই নজরুলই আবার কালীকে নিয়ে শ্যামাসংগীত লিখেছেন: “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন। (তার) রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন।”

আবার রসুলকে নিয়ে নাত: “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে। মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে। যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।”

নজরুল তার সারাজীবনে কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, করেছেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তিনি সারাজীবন চেষ্টা করেছেন ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার আর তার কারণেই মানবধর্মের উপর তিনি বারবার জোড় দিয়েছেন, বলেছেন শোষণহীন সমাজের কথা। তার মতো করে এতো সুন্দর করে এতোটা সাহস করে আর কে কবে বলেছে:

“মোরা এক বৃত্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।

মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।”

Comments

The Daily Star  | English
Garment factory owners revise minimum wage upwards to Tk 12,500

Workers’ minimum wage to be reviewed

In an effort to bring normalcy back to the industries, the government will review the workers’ wage through the minimum wage board, the interim government has decided.

2h ago