মামলা ভোগান্তিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ‘আসামী’ শিক্ষার্থীরা
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে হওয়া পাঁচ মামলায় পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে ‘গড়িমসি’ করছে। ফলে বিপদে পড়ছে বা পড়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে তাদেরকে। আদালতে হাজিরা দেওয়া নিয়ে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে এসব মামলার ‘আসামি’ শিক্ষার্থীদের। মামলা হওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে হাজিরা দিতে হচ্ছে অনেককেই। আসামিদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুনানির তারিখের সঙ্গে পরীক্ষার তারিখ মিলে গেলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
গত বছরের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও পরবর্তীতে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও ভাঙুরের ঘটনায় এসব মামলা করা হয়। মামলার ‘আসামি’ শিক্ষার্থীরা জামিনে মুক্ত থাকলেও কখন যে জামিন বাতিল হয়ে গ্রেপ্তার হতে হয়, সেই আশঙ্কা সব সময় তাড়া করে তাদেরকে। এই অবস্থায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা মামলার দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল রাতে উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ঘটনায় অজ্ঞাত লোকজনকে আসামি করে শাহবাগ থানা পুলিশ তিনটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে একটি মামলা হয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ও অন্যগুলোতে ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা দান, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তার মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়।
এসব ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, হামলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পেশাদার ছিলো। তিনি বলেছিলেন, যে কায়দায় ভাঙচুর করা হয়েছে, যে মাত্রায় ভাঙচুর করা হয়েছে... সিসিটিভি ক্যামেরা শুধু খুলে নেওয়া হয়নি, এটির হার্ডডিস্কটা যে কায়দায় খুলে নেওয়া হয়েছে, সেটি কোনো পেশাদার লোকের কাজ বলে আমাদের কাছে মনে হয়।
পাঁচ মামলার মধ্যে আইসিটি আইনে হওয়া মামলাটিতে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁনকে অভিযুক্ত করা হয়। দাবি বাস্তবায়নে গত বছরের ৩০ জুন থেকে নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে অভিযোগ ওঠে যে বেশিরভাগ গ্রেপ্তারের ঘটনাতেই সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার হিসেবে দেখায়। এরপর ভিন্ন ভিন্ন মামলায় তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
তদন্ত সম্পন্ন করতে সময় চায় পুলিশ
গত এক বছরে দেখা গেছে, মামলাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য দফায় দফায় পুলিশের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়েছে। উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এখন পর্যন্ত ১১ বার সময় বাড়িয়েছে আদালত। এই মামলার পরের শুনানির তারিখ আগামী ১৩ জুন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার ফজলুর রহমান বলেন, এই মামলার প্রতিবেদন দিতে আরও সময় প্রয়োজন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এটা কোনো সহজ ঘটনা নয়। সব আসামিই এখানে অজ্ঞাতপরিচয়। আমরা সাতজনকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছি এবং তদন্তও চলছে। প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময় লাগবে।”
ওই ঘটনায় কোনো ছাত্রনেতার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আন্দোলনের সঙ্গে ওই ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে।” তবে কী ধরনের সম্পর্ক সে ব্যাপারে আর বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
রাশেদ বলেন, মামলার চারজন আসামিকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হয়। প্রত্যেক বার শুনানিতে অংশ নিতে যাতায়াত বাবদই দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এই খরচ তাদের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘চাপে রাখতে মামলার কৌশল’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বলছেন, চাপে রাখার কৌশল হিসেবে বিভিন্ন মামলায় তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। রাশেদের ভাষ্য, পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত করলে সেসব ঘটনায় তাদের কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে না। সবাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
রিমান্ড আবেদনে পুলিশ বলেছিলো, উপাচার্যের বাড়িতে হামলার সঙ্গে রাশেদ নিজেও জড়িত ছিলেন। একটি ‘স্বার্থান্বেষি মহল’-এর সহযোগিতায় ওই ঘটনা ঘটানো হয়।
দ্য ডেইলি স্টারকে রাশেদ বলেন, দুই দফায় ১৫ দিনের রিমান্ডে পুলিশের তিনটি দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এই আন্দোলনে বিএনপির কথিত ১২৫ কোটি টাকা ঢালার ব্যাপারেও জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু এগুলো ছিলো শুধুই গুজব।
উপাচার্যের বাড়িতে হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৮ এপ্রিল রাতে পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হওয়ায় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ভবনে গিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু, রিমান্ড আবেদনে পুলিশ বলেছে, তার নির্দেশনা অনুযায়ীই নাকি উপাচার্যের বাসভবনে হামলা হয়।
পুলিশের মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র মশিউর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ৩০ জুন রাতে সূর্যসেন হলের ২৩৮ নম্বর কক্ষ থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে। এরপরই মোটরসাইকেল পোড়ানোর মামলায় তার নাম দেয় পুলিশ। কিন্তু, পরীক্ষার দিন শুনানির তারিখ পড়ায় ঝামেলায় পড়তে হয়েছে তাকে।
বলেন, “পর পর দুই বার শুনানির দিন অনুপস্থিত থাকলে আমাকে আবার জেলে পাঠানো হতে পারে। এ নিয়ে মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছি আমি।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছর এপ্রিল মাসে দেশের প্রায় সকল পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে কোটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
Comments