সাহসীদের পাশে সরকার নয়, থাকে সাধারণ মানুষ
তার সঙ্গে কথা হয় প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দুটি টিম অনিয়মের অভিযোগে দেশের নামকরা ১২টি বাস কোম্পানিকে জরিমানা করে।
কথা বলার একপর্যায়ে তিনি বলছিলেন যে বাস কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ঈদের আগে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিস্তর অভিযোগ। তাই তারা এ অভিযান পরিচালনা করেছেন এবং একে আরও জোরদার করবেন। পরেরদিনও, অনিয়মের অভিযোগে তারা আরও বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানিকে জরিমানা করেন।
তার পরের দিন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন বিআরটিএতে ঈদ পূর্ববর্তী প্রস্তুতি সভা করলেন, দুইজন প্রথম সারির পরিবহন নেতা (একজন বাস মালিকদের নেতা যার বাস কোম্পানিকেও জরিমানা করা হয়েছিল) তুললেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের কথা। বললেন এ ধরনের অভিযানের মধ্যে তাদের পক্ষে গাড়ি চালানো কঠিন। এও জানালেন তারা ওইদিনই অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পরের দিন থেকে বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযানের খবর আর শুনিনি।
তবে অধিদপ্তর তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন নামীদামী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন দামী ব্রান্ড যাদের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে দেখে মানুষ অভ্যস্ত,তুলনামূলকভাবে দাম একটু বেশি হলেও যেখান থেকে মানুষ পণ্য বা সেবা নেন বিশ্বাস করে।
অভিযানের ফলে এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে মানুষ ঠকাচ্ছে,তার কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে। কখনো মানহীন পণ্য, কখনো বা দুই-তিন গুন বেশি দাম রাখার তথ্য জানা যাচ্ছে। এসব অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপ পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার, যার কথা শুরুতে বলেছি।
অভিযান নিয়ে বা মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় ৩ জুন সোমবার। যখন নামকরা প্রতিষ্ঠান আড়ং এর দুটি পণ্যের মূল্য তালিকায় গড়মিল পায় । আর এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটির একটি আউটলেট কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেয় এবং সাড়ে চার লাখ টাকা জরিমানা করে।
এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খবর আসে মঞ্জুর মোহম্মদ শাহরিয়ারকে তার পদ থেকে বদলি করা হয়েছে। তাকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের খুলনা জোনে এস্টেট ও আইন কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। সরকারি পরিপত্রে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে “জনস্বার্থ”। ( এ লেখা যখন লিখছি তখন টিভি স্ক্রলে দেখলাম বদলির এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।)
তবে এ ধরনের বদলির ঘটনা নতুন কিছু নয়। নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর কথা, যিনি কিনা এক কথায় বলতে গেলে পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করেছিলেন। নদী ও পরিবেশ দূষণের জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের জরিমানা করেছিলেন। অনেক দূষণকারী প্রতিষ্ঠানকে দূষণ রোধে ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) প্রতিষ্ঠা ও তা সর্বক্ষণ চালু রাখতে বাধ্য করেছিলেন।
একটা ঘটনা বলি, যতদূর মনে পড়ে ২০১১ শেষের দিকে। জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি।
বলা হলো, মুনীর চৌধুরী অভিযান চালাবেন, সেটা কভার করতে হবে। তো খুব সকালে গেলাম পরিবেশ অধিদপ্তরে। আরও দুই-একজন সাংবাদিকসহ তার সঙ্গে রওনা দিলাম অভিযানে। তখনও জানি না অভিযান কোথায় হবে। তার সঙ্গে থাকা লোকজনও জানেন না অভিযান সম্পর্কে। গেলাম সাভারে। একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নদী দূষণের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। অফিসে এসে রিপোর্ট লিখতে বসবো তখন সম্পাদক ডাকলেন এবং অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলেন। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তারা আসলেই দোষী কিনা, কী দেখেছি ইত্যাদি। বললাম, অভিযোগের সত্যতা রয়েছে বলে মনে হয়েছে।
সম্পাদক বললেন, ঠিক আছে যা দেখেছো তাই লেখো। লিখলাম। পরে জেনেছি কোন একটি অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে অফিসে ওই অভিযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। পরের দিন আমাদের একজন সিনিয়র রিপোর্টার, যার পরিবেশ বিষয়ে রিপোর্ট করার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সাভারে গিয়েছিলেন এবং তিনিও অভিযানে যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন।
তবে মুনীর চৌধুরী তার এ কাজ সেখানে বেশি দিন চালাতে পারেননি। তাকেও বদলি করা হয়। তিনি যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়েছেন সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারেননি। সর্বশেষ, তিনি যখন দুর্নীতি দমন কমিশনে মহাপরিচালক (এডমিন) হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে আবার আলোচনায় আসেন। তিনি দুদকের একাধিক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং দুদক অফিসে কর্মকর্তাদের মধ্যে সময়ানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তাকে সেখান থেকেও বদলি করা হয়।
শুধু মঞ্জুর মোহম্মদ শাহরিয়ার বা মুনীর চৌধুরী নয়, প্রশাসনে হয়তো আরও অনেক ব্যক্তি আছেন যারা তাদের ভালো কাজের জন্য যেখানে প্রশংসিত হওয়ার কথা তার বদলে পান বদলির আদেশ বা নানা হয়রানি।
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার কারণে হোক বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার কারণেই হোক, মঞ্জুর মোহম্মদ শাহরিয়ারের বদলি আদেশ স্থগিত হয়েছে এবং তিনি আবার স্বপদে বহাল হবেন, ভালো কথা। কিন্তু এই ঘটনা ইতিমধ্যে কিছু মেসেজ (পড়ুন চিলিং ইফেক্ট) দিয়ে গেছে—সেটা হলো প্রভাবশালীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে তোমাকে ভুগতে হবে, তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। অনেকে বিপদে পড়ার ভয়ে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করতে পারেন।
আবার একটা ভালো দিকও আছে, সেটা হলো কেউ যদি ভালো কাজ করেন সাধারণ মানুষ তার পাশে থাকেন। যার কারণে অনেক সময় সরকারও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়। আশা করি মঞ্জুর মোহম্মদ শাহরিয়ার ভালো দিকটিই গ্রহণ করবেন এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে পালন করবেন। ১৬ কোটি ভোক্তার ভালোর জন্য কাজ করবেন।
তুহিন শুভ্র অধিকারী: স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments