বর্তমান বাজেট প্রসঙ্গে বললেন সাবেক অর্থমন্ত্রী

• এক কোটি লোককে করের আওতায় আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে

• বিভিন্ন স্তরের ভ্যাট প্রথা চালুর ব্যাপারে একমত

• ব্যাংকের মালিকরাই এটি লুটেপুটে খেয়েছে

• একটি ব্যাংক ব্যর্থ হলে তা দেশের অর্থনীতিতে চরম সঙ্কট তৈরি হবে

• ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা উচিত

• রাষ্ট্রায়ত্ত পাট ও চিনি কলগুলোর প্রয়োজন নেই

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন যে, বাজেট পেশ করতে গিয়ে তার উত্তরাধিকারী তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন। সেগুলো হলো- জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ানো, অধিক রাজস্ব আদায় এবং নড়বড়ে ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়ন।

সম্প্রতি রাজধানীর বনানীতে নিজের বাসায় বসে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে মুহিত বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জিডিপির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেটের আকার বাড়ানো।”

মুহিত এমন এক সময়ে নিজের বাজেট অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললেন, যেখানে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল আগামীকাল বৃহস্পতিবার তার প্রথম বাজেট পেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এর আগে, আওয়ামী লীগের আমলে ১০ বার এবং এরশাদ সরকারের আমলে দুই বার মিলিয়ে রেকর্ড ১২ বারের মতো বাংলাদেশের বাজেট পেশ করেছিলেন মুহিত।

আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসাবে তিনি ২০০৯ সালে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকার প্রথম বাজেট পেশ করেন এবং ২০১৮ সালে প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে তার মেয়াদ শেষ করেন।

মুহিত বলেন, “বাজেটের আকার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তুলনায় ছিলো কম, কারণ বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় কর আদায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।”

মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আয় ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়ায়।

সরকারকে আয়কর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “রাজস্ব আয় জিডিপির ১৫ শতাংশে উন্নীত হওয়া উচিত।”

বর্তমানে মোট রাজস্বের আয়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ আসে আয়কর থেকে। বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যায় সম্পদশালী লোক থাকায় আয়কর আদায়ের এই হার ৫০ শতাংশে থাকা উচিত ছিলো বলে মনে করেন মুহিত।

অধিক রাজস্ব আয়ের জন্য দেশে করদাতার হার বাড়াতে হবে এবং ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৪ কোটি লোককে করের আওতায় আনতে হবে।

“এটি সম্ভব না হলেও, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত এক কোটি লোককে করের আওতায় আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে,” ভাষ্য মুহিতের।

বর্তমানে দেশে মাত্র ১৫ লাখ লোক নিয়মিত প্রত্যক্ষ কর দেন।

মুহিত বলেন, “মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং শুল্ক থেকে আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। আমি বিভিন্ন স্তরের ভ্যাট প্রথা চালুর ব্যাপারে একমত।”

সাবেক এই অর্থমন্ত্রী আরও জানান যে, বাজেট তৈরির সময় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি নিজেও সমস্যায় পড়তেন।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আপনি যদি উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন, তাহলে আপনি এটি নিয়ে হইচই শুনতে পাবেন। কিন্তু, কম লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে আপনার কাছে জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে না।”

সাবেক এই আলার মতে, বাজেট বাস্তবায়নও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি জানান, তার দীর্ঘ আমলে বাজেট প্রণয়নকালে তিনি কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হননি।

তবে, ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে চাপ তৈরির চেষ্টা করে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন যে বাজেট প্রস্তুতিতে এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং বিজিএমইএ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

“আপনি যাই করতে চান না কেনো এসব সংস্থার সঙ্গে আপনাকে কথা বলতেই হবে। তাদেরকে অখুশি রেখে কোনো কাজই করতে পারবেন না। কেনো না, দিন শেষে আপনার টাকা লাগবে।”

মুহিতের মতে, নতুন অর্থমন্ত্রীর আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন। “একটি ব্যাংক ব্যর্থ হলে তা দেশের অর্থনীতিতে চরম সঙ্কট তৈরি করবে। তাই আমার সময়ে আমি ব্যাংকিং খাতকে গুরুত্ব দিয়েছিলাম এবং কোনো ব্যাংককে দেউলিয়া হতে দেইনি।”

ফারমার্স ব্যাংকের সঙ্কট সম্পর্কে তিনি বলেন, “ব্যাংকের মালিকরাই এটি লুটেপুটে খেয়েছে। আমি এই ব্যাংকটিকে অকার্যকর বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারতাম।”

২০১৩ সালে বেসরকারি এই বাণিজ্যিক ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র তিন বছরের মাথায় আর্থিক অনিয়মের কারণে আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ফারমার্স ব্যাংকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে।

এর ফলে এক পর্যায়ে ফারমার্স ব্যাংকের নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়। ব্যাপক অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির হাত থেকে বাঁচাতে ও ব্যাংকটির ইমেজ ফিরিয়ে আনার জন্যে এছাড়া আর কিছু করার ছিলো না।

“ব্যাংকটিকে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো। এখন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। একে একটি নিয়মের মধ্যে আনা উচিত,” মন্তব্য মুহিতের।

দেশে বর্তমানে ৬৮টি ব্যাংক রয়েছে। এই সংখ্যাটি সদ্য সাবেক হওয়া এই অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে এতোটাই বেশি যে তিনি মনে করেন, ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা উচিত।

আইন ও নিয়মকানুন মেনে ব্যাংকিং খাত পরিচালনার পাশাপাশি  ব্যাংকগুলোকে খুব বেশি স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন মুহিত।

তার মতে, একটি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১,০০০ কোটি টাকা করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে এই সংখ্যা ২০ এ নামিয়ে আনা উচিত।

মুহিত বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবো এবং ব্যাংকিং খাত নিয়ে তাকে কিছু পরামর্শ দিবো। তাকে জানাবো কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।”

তিনি বলেন, তিনি মুনাফামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কর আরোপের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এমনটা করা হলে প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত খরচ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাট ও চিনি কল সম্পর্কে মুহিত বলেন, শ্রমিকরা যেহেতু সেগুলোকে লাভজনক করতে পারেনি তাই বাংলাদেশে সেগুলোর প্রয়োজন নেই। “কিন্তু, তারা আন্দোলন করে বেতন-ভাতা আদায় করে নিচ্ছে।”

তার মন্তব্য, “পাটকল থেকে কোনো টাকা আসবে না অথচ সেখানে টাকা ঢালতে হবে।” একইভাবে, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলোর প্রয়োজন নেই কারণ, সেগুলো লাভজনক নয়। এখন বিটরুট থেকে চিনি উৎপাদিত হচ্ছে যা আখ উৎপাদনের খরচের চার ভাগের এক ভাগ।

থাইল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার মতে, “থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।”

Comments

The Daily Star  | English
Banks deposit growth in 2024

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

13h ago