অভিযোগ ‘হত্যার হুমকি’র তদন্ত ‘অবৈধ সম্পদ’র!
ডিআইজি মিজান, সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম ও দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাক্রম, তার প্রেক্ষিতে কিছু কথা। বলে রাখা দরকার যে একের পর এক ঘটনাগুলো সামনে এসেছে, চাপা পড়েছে, আবার সামনে এসেছে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মনোজগতে হতাশা জন্ম দেওয়ার মতো অনেক উপাদান রয়েছে ঘটনাগুলোতে।
প্রথমে আসি ডিআইজি মিজান প্রসঙ্গে। ডিআইজি মিজান আলোচনায় এসেছেন, আলোচনা সাময়িক চাপা পড়েছে, আবার আলোচনায় এসেছেন। ডিআইজি মিজান প্রথম যখন আলোচনায় আসেন তখন পুলিশের আইজি ছিলেন একেএম শহীদুল হক। তার মুখ থেকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে আসা প্রথম অভিযোগ বিষয়ে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি।
‘ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে একজন নারী মিডিয়া কর্মীর অভিযোগ যখন আমার কাছে আসে, তখন আমি আইজিপি ছিলাম। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে সংযুক্ত করি। এবং তার বিরুদ্ধে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত টিম গঠন করি। আমি জানি, তদন্ত করে প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকিটার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।’
কী ছিলো সেই প্রতিবেদনে?
‘তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিলো, সেই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি। সেই প্রতিবেদনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।’ (ডিবিসি নিউজ, ১২ জুন ২০১৯)
ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো তিনি একজন সংবাদ পাঠক নারীকে প্রভাব ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্পর্ক গড়েছেন, নিপীড়ন করেছেন। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া, টেলিফোনে হত্যা-কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিলো ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। হুমকির টেলিফোন সংলাপের অডিও, একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই নারী সরাসরি অভিযোগও করেন। তা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে, সংবাদকর্মীকেও হত্যার হুমকি দেন ডিআইজি মিজান, এমন অভিযোগও সামনে এসেছিলো।
সংবাদ পাঠক নারী যে অভিযোগ করেছিলেন, সেই অভিযোগেরই তদন্তে সত্যতার প্রমাণ পেয়েছিলো পুলিশের গঠিত তদন্ত কমিটি। যে কথা বলেছেন সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক।
ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে নারীর অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো প্রায় বছর দেড়েক আগে। কিন্তু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সাবেক আইজিপি ‘প্রত্যাহার’ করে তাকে যে ‘শাস্তি’ দিয়েছিলেন, তার বাইরে আর কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি ডিআইজি মিজানকে। সংবাদকর্মীদের হত্যার হুমকিসহ অন্য অভিযোগগুলোর কোনো তদন্তও হয়নি।
‘প্রত্যাহার’ আসলে ‘শাস্তি’ কী-না, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু, পুলিশ বাহিনী এর থেকে বের হয়ে আসেনি। দায়িত্ব থেকে ডিআইজি মিজানকে ‘প্রত্যাহার’ করে পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত করেছিলেন আইজিপি। তিনি এখনও ‘ডিআইজি’ পদমর্যাদায় পুলিশ বাহিনীতে বহাল আছেন!
বিস্মিত হওয়ার এখানেই শেষ নয়। সংবাদ পাঠক নারীকর্মী ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করেছেন ‘প্রতিশ্রুতি-লোভ ও হত্যার হুমকি’ দেওয়ার। কিন্তু, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ যার প্রমাণ পুলিশের তদন্ত কমিটি পেয়েছিলো, তা নিয়ে অধিকতর কোনো তদন্ত হচ্ছে, এমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে অবৈধ উপায়ে তিনি সম্পদ অর্জন করেছেন কী-না, তা নিয়ে। দুদক নিশ্চয়ই তা করতে পারে, করা দরকারও। তা নিয়ে কোনো সমস্যা বা আপত্তি নেই। প্রশ্ন হলো মূল অভিযোগ চাপা দিয়ে, অবৈধ সম্পদের তদন্ত করা হচ্ছে কী-না?
আদালত প্রশ্ন তুলছেন, ডিআইজি মিজান কী দুদকের চেয়ে শক্তিশালী কী-না, কেনো তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? এই প্রশ্ন আসছে তার ‘অবৈধ সম্পদ’ ইস্যুতে। নারী সংবাদ পাঠকের যে অভিযোগ, যে অভিযোগের প্রমাণ পুলিশের তদন্ত কমিটি পেয়েছিলো, সেই বিষয়টি কিন্তু কোনো আলোচনায় নেই। কেনো নেই, এ প্রশ্ন তোলারও সম্ভবত কেউ নেই!
২.
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ২০ দিন পর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ওসি মোয়াজ্জেম গ্রেপ্তার হবে, হয়েছে। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানানো হচ্ছে। দেরিতে হলেও গ্রেপ্তার তো হয়েছে। হ্যাঁ, গ্রেপ্তার হয়েছে। ধন্যবাদও জানাই এবং প্রশ্ন সামনে আনার প্রয়োজন মনে করছি, সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?
নুসরাত নিপীড়নের শিকার হয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওসি মোয়াজ্জেমের কাছে গিয়েছিলেন বিচারের প্রত্যাশায়। মোয়াজ্জেম বেআইনিভাবে নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেছেন, তা ছড়িয়ে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বেআইনিভাবে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ। মূল অভিযোগ কী?
আইন অনুযায়ী নিপীড়িত নুসরাতের পাশে দাঁড়াননি সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম তথা স্থানীয় পুলিশ। ঘটনাক্রম দৃশ্যমান করেছে, নুসরাতের হত্যাকারীদের পক্ষ নিয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম। নিপীড়নের বিষয়টি তার জানা থাকলেও, হত্যার বিষয়টি তার অজানা না হলেও, তিনি বিষয়টিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রচারণা চালিয়েছেন। গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। আইন অনুযায়ী সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম যদি নুসরাতের পাশে দাঁড়াতেন, হয়তো অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না বা কার্যকর করতে পারতো না। এখানেই প্রশ্ন এসেছে, হত্যা মামলার চার্জশিটে তাহলে কেনো সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না?
ব্যাখ্যা এসেছে দুই রকম। তিনি তো সরাসরি ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ করেননি। তিনি দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, আইন অনুযায়ী তার যা করার কথা ছিলো, তা তিনি করেননি। এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়, হত্যা মামলার আসামি করা যায় না।
অন্য ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, তিনি নিষ্ক্রিয় থাকেননি, শুধু দায়িত্বে অবহেলা করেননি। তিনি হত্যাকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। হত্যাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেছেন। তিনি দায়িত্ব পালন করলে নুসরাতকে জীবন দিতে হতো না। নিষ্ক্রিয় বা দায়িত্বে অবহেলা নয়, হত্যাকারীদের পক্ষ নেওয়ায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের নাম হত্যা মামলার চার্জশিটে থাকা দরকার ছিলো। এই দুই মত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে, চলবে হয়তো অনেকদিন। একটা পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয়েছে।
সেদিকে না গিয়ে আমরা বরং সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে কথা বলি।
এতো গুরুতর অভিযোগের পর পুলিশ সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে ফেনীর সোনাগাজী থানা থেকে ‘প্রত্যাহার’ করে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। তারপর রংপুর রেঞ্চে বদলি করেছে। একজন আইনজীবী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়টি নিয়ে আদালতে গেছেন। আদালত সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ‘ঢাকা-ফেনী-রংপুর-যশোর’ ঘোরাঘুরি করেছে। রংপুর রেঞ্চের ডিআইজি বলেছেন, সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম ঢাকায় গেছেন। ঢাকা বলেছে, ওসি মোয়াজ্জেম ঢাকায় নেই। তিনি ছুটিতে নয়, অফিসে আসছেন না। প্রথমদিকে তার মোবাইল ফোন খোলা থাকলেও, পরে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর পুলিশ স্বীকার করে যে, সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম পলাতক। গ্রেপ্তার করতে সময় লাগবে, তবে গ্রেপ্তার হবে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। আদালতের নির্দেশে ২০ দিন পর গ্রেপ্তার হয়েছেন।
দুটি প্রশ্ন, প্রিয় পাঠক উত্তর নিজেরা খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
এই পুরো ঘটনায় পুলিশ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
ফেনীর সেই এসপি, যিনি নুসরাত হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা দেখিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি লিখেছিলেন, তিনি কোথায়? কোনো বিভাগীয় শাস্তি-তদন্ত হয়েছে, হচ্ছে?
৩.
আবার ডিআইজি মিজান প্রসঙ্গ। তিনি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন, দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা এনামুল বাছিরকে। এমন দাবি করে তিনি নিজেই প্রমাণ হিসেবে অডিও বাজারে ছেড়েছেন।
আলোচনা হচ্ছে ‘ঘুষ দেওয়া-নেওয়া সমান অপরাধ’ শাস্তি হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘ডিআইজি মিজানের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ সত্যি হলে শাস্তি হবে’। সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হলে তিনি অপরাধী। যদি অভিযোগ প্রমাণ না হয়, মিথ্যা অভিযোগে একজনকে বিপদে ফেলার জন্যেও তিনি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন’। (ডিবিসি নিউজ,১২ জুন ২০১৯)
‘হচ্ছে’ ‘হবে’ শোনা গেলেও, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের কারণ হিসেবে দুদক মহাপরিচালক চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। ‘ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে নয়, তথ্য পাচারের অভিযোগে বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে’।
সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে দুদক মহাপরিচালক বলেছেন, ‘ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তো প্রমাণ হতে হবে। বাছিরকে বহিষ্কার করা হয়েছে দুদকের তথ্য পাচারের অভিযোগে’।
দুদক মহাপরিচালকের বক্তব্য থেকে প্রশ্ন আসে, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের তদন্ত হয়নি, প্রমাণ হয়নি। এ কারণে তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। একইভাবে তথ্য পাচারের অভিযোগেরও তদন্ত হয়নি, প্রমাণ হয়নি। তাহলে তথ্য পাচারের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কীভাবে?
৪.
শাসন বা নিপীড়ন দৃশ্যমান, সুশাসন নয়। ঘুষ দিয়ে, প্রমাণ হিসেবে টেলিফোন সংলাপ প্রকাশ করেও একজন পদে বহাল। ‘শাস্তি পেতে হবে’ শোনা গেলেও, মূল অভিযোগ কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে।
একজন সাময়িক বরখাস্ত, ভিন্ন অভিযোগে। আরেকজন গ্রেপ্তার, বহু নাটকীয়তার পর। কেমন যেনো একটা কোটারিভূক্ত ব্যবস্থাপনা। রাখ-ঢাক করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, আইনের শাসনের দৃষ্টিকটু পর্যায়ের ঘাটতি। ‘এগিয়ে যাওয়া’ গল্পের সঙ্গে যা একেবারেই বেমানান।
Comments