‘যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াবো সেই সরিষার মধ্যেই ভূত’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে, ভেজাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না কেনো?

সরকার আন্তরিকভাবে ভোক্তা তথা জনগণের নিরাপদ খাদ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় কী না, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমাদের ল্যাব ভালো, মানসম্পন্ন।

পণ্য পরীক্ষা করেছি নৈতিকতার সঙ্গে, নির্মোহভাবে।

আমাদের পরীক্ষার ফলাফল সঠিক, দৃঢ়তার সঙ্গে তা বলতে পারি।

বিএসটিআইয়ের ল্যাব ভালো, যোগ্য মানুষ আছেন। কিন্তু, বিএসটিআই সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়।

আমাদের ফলের সঙ্গে কেনো তাদেরটা মিলল না, সে প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারবেন।

A B M Faruque
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক এবং বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার এবং ফার্মেসি অনুষদের যৌথ গবেষণায় গতকাল (২৫ জুন) জানানো হয়, ঢাকার বাজার থেকে সংগৃহীত সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বেশ কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে বিশেষ করে, দুধে ডিটারজেন্ট-এন্টিবায়োটিক-ফরমালিন এবং মশলায় টেক্সটাইল রঙ রয়েছে। এছাড়া, ভোজ্য তেলও মানহীন।

একই দিন সরকারের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলে তাদের পরীক্ষায় দুধে কোনো ক্ষতিকর উপাদানের প্রমাণ মেলেনি। দুটি পরীক্ষার সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের তথ্য! বিএসটিআই যেসব প্রতিষ্ঠানের দুধ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্স সেন্টার ও ফার্মাসি অনুষদের নমুনাতেও সেসব প্রতিষ্ঠানের দুধ ছিলো। ভেজাল নিয়ে জনমনে এমনিতেই অস্বস্তি-বিভ্রান্তি রয়েছে। এখন দুই পরীক্ষার দুই রকম ফলাফলে সেই বিভ্রান্তি আরো বাড়লো। বাড়লো ভেজাল বিষয়ে আতঙ্কও।

বিএসটিআইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের অভিযোগ উঠেছে। আন্তরিকতার অভাব, অসততা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সখ্যতা, মানহীন পণ্যের মানসম্পন্ন সার্টিফিকেট দেওয়া, এমন বহু অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসটিআই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্স সেন্টার ও ফার্মাসি অনুষদের সততা-নৈতিকতা ও মান নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন কখনো উঠতে দেখা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক এবং বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের একটি উজ্জ্বল পরিচিতি-ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। ফলে তাদের পরীক্ষায় পাওয়া তথ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তারা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, সততা-নৈতিকতা বজায় রেখে ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করেছেন। তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি ও ফলাফল সঠিক, তা তিনি বলছেন জোর দিয়ে।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। গবেষণার প্রক্রিয়া, মান এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তাসহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

অধ্যাপক ফারুকের কাছে জানতে চাওয়া হয়- আপনারা গবেষণা করে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন সেই প্রতিবেদনের জন্যে কীভাবে নমুনা সংগ্রহ করেছেন? কীভাবে সেই তথ্যগুলো বের করেছেন?

উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা সব সময়ই আমাদের ফ্যাকাল্টিতে ওষুধ, খাদ্য ও প্রসাধনীর মান পরীক্ষা করি। অ্যাকাডেমিক কারণে তথা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার ধারাগুলো শেখানোর অংশ হিসেবে এটি করি। মাস্টার্সে থিসিসের কাজ যারা করেন তারাও এধরণের কাজ  করেন। এবার এই কাজটি করার জন্যে আমরা বেশি পরিমাণের নমুনা নিয়েছি। রাজধানীর পলাশীবাজার এবং আনন্দবাজার থেকে বেশিরভাগ এবং নিউমার্কেট কাঁচাবাজার থেকে কয়েকটি পণ্যের নমুনা নিয়েছি। আগে থেকে আমাদের কোনো সিলেকশন ছিলো না। আমরা র‌্যান্ডমলি নিয়েছি।

দুধের নমুনা আমরা সংগ্রহ করেছি পলাশীবাজার এবং মোহাম্মদপুর বাজার থেকে।”

আপনাদের ল্যাবের অবস্থা কেমন? ল্যাব কতোটুকু মানসম্পন্ন?- “আমাদের ল্যাবের অবস্থা ভালো। এটি ভালো এজন্যে যে যেহেতু গবেষণাগুলো ব্যয়বহুল তাই আমরা যন্ত্রপাতির জন্যে প্রতি বছরই সরকারের কাছ থেকে ভালো পরিমাণের অনুদান পাই। আমরা সেগুলো ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করি এবং সেগুলোকে কাজে লাগাই। অনেক সময় আমরা পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়েও ভালো কাজ করতে পেরেছি। আমাদের সেসব প্রতিবেদন দেশ-বিদেশের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের সক্ষমতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। আমরাও জানি যে আমরা কতোটুকু পারবো আর কতোটুকু পারবো না। যে গবেষণা আমরা পারবো না তা করবো না। আমাদের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্স-এ অনেক দামি যন্ত্রপাতি রয়েছে যা অনেক সরকারি ল্যাবরেটরির চেয়েও অনেক ভালোভাবে মেইন্টেন করা হয়। আমাদের জটিল এবং ব্যয়বহুল গবেষণাগুলো সেই সেন্টারের ল্যাবে করি।

যেমন একটি ঘটনা বলি, আমাদের এবারের গবেষণা প্রতিবেদনে সংগৃহীত গুঁড়া হলুদের নমুনাগুলোর বেশ কয়েকটিতে ‘মেটানিল ইয়েলো’ নামের টেক্সটাইল রঙের উপস্থিতি পেয়েছি। আমরা কিন্তু জানিয়েছি যে এই পরীক্ষাটি আবার পর্যালোচনা করে নিশ্চিত করা হবে। আমাদের কাছে অবাক লাগছে যে আমাদের দেশেও হলুদের গুঁড়াকে আরো হলুদ করার জন্যে ‘মেটানিল ইয়েলো’- ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিশয় উক্তি দিয়ে কিছু প্রকাশ করা নৈতিকভাবে ঠিক নয় বলে আমরা মনে করি। তাই এটি নিয়ে আমরা আরো গবেষণা করার পর তথ্যটি প্রকাশ করবো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।

নৈতিকতার একটি বিষয় রয়েছে। যন্ত্রপাতি ভালো, সবকিছু ভালো কিন্তু, মনটা ভালো না। অর্থাৎ আমি কারো দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত, তাহলে যতো ভালো ল্যাব বানান না কেনো, ভালো রেজাল্ট পাবেন না। আমাদের ফ্যাকাল্টিতে এই সমস্যাটি নেই বলেই আমি দাবি করি। আমার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার মান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।”

আপনাদের ওপর গণমাধ্যম ও জনগণের আস্থা রয়েছে আবার বিএসটিআই বলছে পণ্যের মান ঠিক রয়েছে। তাহলে সাধারণ মানুষ আসলে কী বুঝবেন? এমন পরিস্থিতিতে আসলে করণীয় কী?- সাধারণ মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে উনি কাকে সমর্থন করবেন। কার কথা গ্রহণ করবেন বা কারটা গ্রহণ করবেন না। বিএসটিআই ল্যাবের অবস্থা ভালো- এটি আমি জানি এজন্যে যে আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে আইডিবি আমাকে সেখানে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলো। সেখানে আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার টাকা সংস্থাটি দিয়েছিলো। তাই বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাদের যন্ত্রপাতি খুব ভালো। কিন্তু, বাকি অংশ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে এ সংস্থাটি সম্পর্কে নানারকম কথা-বার্তা শুনি। সেগুলো শুনতে ভালো লাগে না।

বিএসটিআইয়ের ল্যাব ভালো, যন্ত্রপাতি ভালো। ওখানে অনেক অভিজ্ঞ লোকজনও রয়েছেন। পণ্যের মান নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে কেনো তাদের সিদ্ধান্তের পার্থক্য হলো তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আর আমাদের সক্ষমতা-আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

আপনাদের এই প্রতিবেদন কি সরকারের কাছে জমা দিবেন?- “অবশ্যই জমা দিবো।”

আপনি মনে করেন কি আপনাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার মান-উত্তীর্ণ না হওয়া পণ্যের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে?- “আমরা আমাদের গবেষণা প্রতিবেদন জমা দিবো। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নিবে তারা এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিবে।”

আপনাদের এই গবেষণা প্রতিবেদনটিকে সরকার কি মানসম্পন্ন বলে গণ্য করবে?- “একটি ঘটনা বলতে পারি- আমাদের ফার্মেসি অনুষদ থেকে আমরা যে গবেষণা করি, যেমন ২০টি ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল করার সুপারিশ, লাইসেন্স হেল্ডআপ করা বা পণ্য বিক্রি বন্ধ করা- এসব কাজ কিন্তু সরকার আমাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করেছে।

আমাদের প্রতিবেদনগুলো আগেও সরকারকে দিয়েছি। এখনো দিচ্ছি। এই গবেষণাগুলো চলমান। তাই আমরা ভবিষ্যতেও সেগুলো সরকারকে জানাবো। শুধু খাদ্য নয়, ওষুধ, প্রসাধনী পণ্য- সব বিষয়েই আমাদের গবেষণা প্রতিবেদনগুলো সরকারকে জানাবো। আর এই নতুন প্রতিবেদনটি দুই-একদিনের মধ্যে সরকারের কাছে জমা দিবো।”

প্রতিবেদনের সঙ্গে আপনাদের কোনো সুপারিশ থাকবে কি?- “না, আমরা কোনো সুপারিশ দিবো না। শুধু প্রতিবেদনটি জমা দিবো। তারপর সরকার চাইলে সুপারিশ দিবো। সরকারকে আগ বাড়িয়ে আমাদের সুপারিশ দেওয়াটা ঠিক হবে না।”

পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের ১০টি নমুনা সংগ্রহ করে আপনারা বলেছেন সেগুলোতে কী কী পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু, সেই পাস্তুরিত দুধ বাজারে কারা আনেন? একজন ভোক্তা কী বুঝবেন কোনটায় কী রয়েছে?- “পাস্তুরিত দুধগুলো যারা উৎপাদন করে তারাই সেগুলো বাজারে আনেন।”

সেগুলোর নাম না বললে ভোক্তারা কীভাবে বুঝবেন যে কোন পণ্যটি মানসম্পন্ন নয়।– “মানসম্পন্ন নয় এমন পণ্যের নাম আমরা বলছি না, কারণ এতে আইনগত সমস্যা রয়েছে। পণ্যের নাম প্রকাশ করার ক্ষমতা রয়েছে বিএসটিআই এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের হাতে।”

বাজারে তো একই প্রতিষ্ঠানের আরো অনেক নমুনা রয়েছে। যাদের দুধ পরীক্ষা করে এন্টিবায়োটিক পেয়েছেন, তাদের তো অন্য পণ্যও বাজারে রয়েছে- যা হয়ত পরীক্ষা করা হয়নি। তাহলে বাজারের বাকি পণ্যগুলো সম্পর্কে ভোক্তাদের কী ধারণা তৈরি হবে?- “বড় আকারে যদি গবেষণা করা যায় যেখানে একেকটি পণ্যের শত শত নমুনা সারা বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হবে, তাহলে বলবো তা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কেননা, আমাদের সেরকম নেটওয়ার্ক নেই। আর তা করতে গেলে যে পরিমাণ তহবিল লাগবে তা তো আমরা পাবো না।”

আপনারা কি তহবিল পাওয়ার জন্যে দাবি করেন?- “না, তা পাওয়ার দাবি আমরা করি না। কেননা, আমরা গবেষণা করি আমাদের অ্যাকাডেমিক কাজের জন্যে। আমাদের গবেষণা দিয়ে আমরা সরকারকে বা সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। আইনগতভাবে যেহেতু আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত না সেহেতু আমরা কোনো একটি ব্র্যান্ড সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করি না।”

ভোক্তাদের পক্ষে তো এতো যাচাই-বাছাই করে পণ্য কেনা সম্ভব হয় না। তাহলে ভোক্তার অধিকার আসলে কে দেখবেন?- “ভোক্তাদের বিষয়ে তো আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত না। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাই দেখবেন।”

সরকার যেহেতু এসবের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে তাহলে তো প্রশ্ন জাগে যে বিএসটিআই কীসের ভিত্তিতে এসব পণ্য বাজারে অনুমোদন দেয়?- “এ প্রশ্নটি বিএসটিআই-কেই করতে হবে। তবে আমি যেহেতু এক সময় বিএসটিআই-এ কাজ করেছি তাই আমার পর্যবেক্ষণ হলো, ওখানে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখলাম, ওখানে বছরে একবার একটি পণ্যের নিবন্ধন নবায়ন করতে হয়। কোম্পানি থেকে পরীক্ষার জন্যে নমুনা জমা দেওয়া হয়। সেই নমুনা পরীক্ষার পর বিএসটিআই যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে তারা নবায়নের আবেদনটি গ্রহণ করে।

এখন ব্যাপারটি হলো যে যদি কোনো অসাধু ব্যবসায়ী তার পণ্যের খুব ভালো একটি নমুনা বিএসটিআইয়ে জমা দেন এবং সেটিতে বিএসটিআইয়ের সন্তুষ্ট না হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। কিন্তু, বাজারে যে পণ্য ছাড়া হচ্ছে তা তো আর পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। বিএসটিআই মাঝে-মধ্যে বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। সেই মাঝে-মধ্যের মাঝখানে যে দিনগুলো থাকে সেসময়গুলোতে তো আমরা সরল বিশ্বাসে পণ্য কিনে যাচ্ছি।

তাই আমি বলতে পারি যে বিএসটিআই প্রতীকীভাবে পণ্যের মান যাচাই করছে।

আসলে নিয়মিত মনিটরিংয়ের একটি ব্যবস্থা থাকতে হবে। হয় সেটি বিএসটিআই করবে তা না হলে অন্য কেউ করবে। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে পারি। ১৯৩৮ সালের আগে সে দেশে আমাদের মতোই অবস্থা ছিলো। আমাদের এখানে এখন যে রকম হচ্ছে হুবহু একই অবস্থা ছিলো। মরা মুরগি থেকে শুরু করে মরা গরুর মাংস বিক্রি করা- সবই হতো। এরপর ১৯৩৮ সালে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গঠন করা হয়।

বিএসটিআইয়ের কাজ হচ্ছে পণ্যের মান দেখে সনদ দেওয়া। আর বাজারে পণ্যের মান বজায় রয়েছে কী না তা মনিটরিং করবে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ একটি থাকবে সার্টিফিকেশন বডি এবং আরেকটি থাকবে মনিটরিং বডি। এফডিএ-র মতো আমাদের শক্তিশালী মনিটরিং বডি থাকলে ভালো হতো। পৃথিবীর ৪২টি দেশে এফডিএ রয়েছে। আমরা ৪৩তম দেশ হতে পারি। আমরা দেশে বিভিন্ন জায়গায় অনেক উন্নতি দেখছি। বাংলাদেশ এখন আগের জায়গায় নেই। সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মতে, আমাদের এই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে এফডিএ-র মতো একটি সংস্থা দরকার।”

বর্তমানে এই মনিটরিংয়ের কাজ কারা করছে?- “এই মনিটরিং আসলে ভালোভাবে হচ্ছে না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কিংবা বিএসটিআই, কিংবা পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন ইত্যাদি প্রায় ১৪টির মতো সংস্থা রয়েছে মনিটরিংয়ের জন্যে। এসব সংস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করে না। আবার তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও রয়েছে।

যারা মনিটরিং করেন তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হওয়ার বিষয়ও রয়েছে। সমন্বয় না থাকলে যা হয়!

আর নৈতিকতার প্রশ্নটি কিন্তু খুবই জরুরি। এফডিএ আমেরিকাতে কোনো কোম্পানিকে যখন কারখানা তৈরি করার অনুমতি দেয় তখন তারা যে শুধু প্রযুক্তি দেখে তা কিন্তু নয়। তারা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (এফবিআই) চিঠি লিখে- যে ব্যক্তি কারখানাটি তৈরি করতে চাচ্ছেন তাকে অনুমতি দেওয়া যায় কী না। তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে কী না তা জানতে চাওয়া হয়। এফবিআই তখন সেই ব্যক্তির নৈতিক অবস্থাও দেখে। যদি তার নৈতিক অবস্থা ভালো হয় তাহলে তার বাবা-দাদার নৈতিক অবস্থাও দেখা হয়। তাহলে কী ভাবা যায় পৃথিবী কোন পর্যায়ে রয়েছে আর আমরা কোন পর্যায়ে রয়েছি?

আমাদের দেশে আনাচে-কানাচে কোথায় কোথায় জঙ্গি রয়েছে তা আমরা খুঁজে বের করতে পারি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ কাজে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। তাহলে জঙ্গিদের ধরা গেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরা যাবে না কেনো?

যে অসাধু ব্যবসায়ী দুধের মধ্যে ডিটারজেন্ট বা ফরমালিন দিচ্ছে তাকে কি ধরা যাবে না? কেনো ধরা যাবে না? এতো কঠিন কাজ করা যাচ্ছে আর এটি জানা যাবে না যে, ফরমালিন কে বিক্রি করছেন আর তা দুধে কে মেশাচ্ছেন? অবশ্যই ধরা যাবে। আমরা ধরতে চাই কী না সেটি হলো একটি বিষয়। আমরা বলতে আমি বুঝাচ্ছি যে আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো যাদের এটি দায়িত্ব তারা তা করতে চান কী না।

এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?- “যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৮ সালের আইনে এফডিএ-কে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে তাকে রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট কোনো দলের নেতা বা সংসদ সদস্য প্রভাবান্বিত করতে পারবে না। রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেট কোনো সরকারের কাছে এফডিএ দায়বদ্ধ না। তারা স্বায়ত্তশাসিত। তারা স্বাধীন।

আর আমাদের অবস্থা হলো- আমরা যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াবো সেই সরিষার মধ্যেই ভূত। তাই নৈতিকতার বিষয়টি আমি বার বার বলছি। আমাদের সমস্যাটিই এখানে। এর চেয়ে কম লোকবল দিয়ে, কম যন্ত্রপাতি দিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ ভালো আছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিবেচনায় ডেনমার্ক হচ্ছে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। ওখানকার লোকগুলোই খাবারে ভেজাল দেয় না। তারা এটি ভাবতেই পারে না যে খাবারে কেনো বিষ মেশাবে! তাই নৈতিকতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের নৈতিকতার বিষয়ে একটু ঝামেলা রয়েছে বলে বিষয়টি ছেড়ে দিলে হবে না। নৈতিকতাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভালো কাজের জন্যে পুরষ্কার এবং খারাপ কাজের জন্যে তিরস্কার করতে হবে। একজন ভালো কাজ করেন আবার একজন ভালো কাজ করেন না অথচ দুজনেই সমান বেতন-ভাতা পান। তাহলে একজন মানুষ ভালো কাজ করার উৎসাহ পাবেন কোথা থেকে? এটিই আমাদের মূল সমস্যা।

মালয়েশিয়াতে বিএসটিআইয়ের মতো সরকারি সংস্থা রয়েছে। কিন্তু, সেটিকে জনগণ খুব বেশি পছন্দ করেন না। তারা পছন্দ করেন একটি বেসরকারি, স্বাধীন সংস্থাকে। এর সার্টিফিকেটকে জনগণ ভীষণ রকমের বিশ্বাস করে। আমাদের দেশেও বেসরকারি খাতে এমন সংস্থা হতে পারে।

আমি জানি এসব বললে যে খুব একটা কাজ হবে, তা কিন্তু নয়। আমরা একটি বৃত্তের মধ্যে রয়েছি। সেই বৃত্তটি ভাঙ্গতে পারছি না। সে কারণে আমাদের ওষুধে ভেজাল, খাবারে ভেজাল। বা আরো বড় বড় অপরাধ ঘটে যাচ্ছে।

আরো পড়ুন:

দুধে ডিটারজেন্ট-এন্টিবায়োটিক-ফরমালিন, মশলায় টেক্সটাইল রঙ, তেল মানহীন

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago