দল বদলের ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি: বাম থেকে তৃণমূল হয়ে বিজেপিতে

দল বদল এখন প্রায় প্রতিদিনের ‘সংবাদ শিরোনাম’ পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে। গোটা রাজ্যের জেলা থেকে আসছে দল বদলের খবর।

থানা (স্থানীয় ভাবে যাকে ব্লক কিমিটি বলা হয়) কমিটি, ওয়ার্ড কমিটি থেকে জেলা কমিটি; কোথায়ও পঞ্চায়েত সমিতি তো কোথাও জেলা পরিষদ বা কোথাও গ্রাম পঞ্চায়েত বা জেলার শীর্ষ নেতা, বিধায়ক প্রাক্তন বিধায়ক দল বদলাচ্ছেন।

যারা দল বদল করছেন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন।

যদিও দল বদলের ইতিহাস নতুন নয়। সমগ্র ভারতে নয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। দল বদল একটি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিতে পারে সেটি দেখা গিয়েছিলো ২০১১ সালে। তখন বামফ্রন্টকে ভোটের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসন ভার নিয়েছিলো।

রাতারাতি বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে ভিড় জমিয়েছিলেন হাজার হাজার রাজনৈতিককর্মী। আর সেই কর্মীদের তৃণমূল কংগ্রেসে ‘স্বাগত’ জানিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ওই সময়ের মমতার পরেই তৃণমূলের ক্ষমতাবান নেতা মুকুল রায়।

অনেকেই মনে করেন, বামফ্রন্ট, কংগ্রেসকে কার্যত ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী এবং মুকুল রায়। ২০১১ সাল থেকে দল বদলে তৃণমূলে আসার হিড়িক কার্যত ঘূর্ণিঝড় হিসাবে ২০১৬ সালেও দেখা গিয়েছিলো। সে বছর ছিলো বিধানসভা নির্বাচন। মমতার দল আবার ক্ষমতায় ফিরবে- এই প্রত্যাশায় বামফ্রন্টের বেশ কয়েকজন বাঘা বাঘা নেতা-প্রাক্তন মন্ত্রী যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। তাদের মধ্যে রাজ্জাক মোল্লা, উদয়ন গুহের মতো বাম নেতাদের নাম না বলা যায়। তাদের কয়েক হাজার অনুসারীও যুক্ত হয়েছিলেন মমতার দলে।

বামফ্রন্টের সময় তৃণমূল যখন এককভাবে লড়াই করেছিলো সেই তৃণমূলে যখন নতুন বামফ্রন্টের লোক যুক্ত হয়ে তৃণমূল হয়ে গিয়েছিলো, সেই নব্য তৃণমূলদের হাতেই পুরনো তৃণমূল কোণঠাসা হয়ে পড়ে। পুরনো তৃণমূল নেতারা যে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ছেন দলে, প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে তৃণমূলেরই বর্ষীয়ান নেতা ও সাংসদ সৌগত রায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সেটি নিয়ে তোলপাড়ও হয়ে হয়েছিলো।

বলা হয়, নব্য তৃণমূলীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলো খোদ কালীঘাট তথা মমতার বাড়ি থেকে। সোজা কথায়, মমতার নির্দেশ ছিলো তাদের গুরুত্ব দেওয়ার। যদিও তিনি পরে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন দলে নতুন-পুরনো সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। কোনও বিভেদ তৈরি করা চলবে না।

মমতার দলটিকে এই নব্য তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো কিছু দিন আগে পর্যন্ত।

কিন্তু, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট বাড়ায় এবং বামফ্রন্ট-কংগ্রেস আরো দুর্বল হয়ে পড়ায় এক শ্রেণির সুবিধাবাদী রাজনীতিক কর্মীরা তৃণমূল থেকে অধিকতর সুবিধার লোভে বিজেপির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিলেন।

বিজেপির পালে হাওয়া লাগছে এমন আঁচ পেয়ে লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই বিজেপিতে যোগদান শুরু হয়। তৃণমূল, কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট- এই তিনটি রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৃণমূল থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টি বা মোদির দলের ভিড় জমাতে দেখা যাচ্ছিলো। যেটি লোকসভা নির্বাচনের পর কার্যত ‘ঝড়’ হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে।

এখন পর্যন্ত তৃণমূলের সাতজন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। মমতার দল থেকে মোদির দলে এসেছেন কমপক্ষে ১০০ জন পৌরসভার জনপ্রতিনিধি। প্রায় ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত তৃণমূলের প্রতিনিধিরা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার মধ্যদিয়ে ক্ষমতার দখল নিয়েছে বিজেপি।

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুকুল রায় দল বদল করানোর মূল কারিগর ছিলেন। সেই কারিগর এখন নিজেই দল বদলে বিজেপিতে। ফলে সেই একই কারিগরের হাত দিয়ে এবার তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগদানের এই ঝড় চলছে।

২০১১ সালে যখন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ তখন সেটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আজ অবশ্য তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যারা যাচ্ছেন, তাদেরকে নিজেই ‘চোর’ হিসেবে মূল্যায়ন করছেন তিনি। শুধু তাই নয়, যে কারিগর মুকুল রায় নিজেই তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন সেই মুকুল রায়কে ‘গাদ্দার’-ও বলছেন মমতা। শুধু মকুল রায় নন, মুকুল রায়ের ছেলে শুভ্রাংশু রায়, মুকুল অনুসারী হিসেবে পরিচিত বিধায়ক সুনীল সিং, ভাটপাড়ার পৌর চেয়ারম্যান সৌরভ সিংও তৃণমূল ছেড়ে এখন বিজেপিতে। বিজেপিতে যোগ দিয়ে অর্জুন সিং লোকসভার সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন ব্যারাকপুর থেকে। এদের সবাইকে মমতা ‘চোর’ বলে আখ্যায়িত করছেন।

২০১১ সালে এদের হাত দিয়ে বামফ্রন্ট থেকে হাজার হাজার কর্মী তৃণমূল যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু, আট বছর পর চিত্রটি পুরোপুরিই বিপরীত।

রাজনীতির আলোচনা, এই দল বদলে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থই গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই বার বার এই দল বদলের ঘটনা ঘটছে। আর ২০১১ সালে যেভাবে মমতা এই দল বদলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন আজ সেই দল বদলের ধারাবাহিকতায় দগ্ধ হচ্ছেন নিজেই।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Public gatherings banned in key Dhaka areas from tomorrow: ISPR

Restrictions imposed to maintain order near Chief Adviser’s Office, military zones

46m ago