নয়ন বন্ড গ্যাং ০০৭
বরগুনায় দিনে দুপুরে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ নয়ন। বরগুনায় তার পরিচিতি ‘নয়ন বন্ড’ নামে। হলিউডের নায়ক জেমস বন্ডের অনুসরণে নিজেকে ‘গড়ে’ তুলতে চেয়েছিলো সে। গড়ে তুলেছিলো ‘নয়ন বন্ড’ বাহিনী। সন্ত্রাস, মাদক চোরাকারবার, ছিনতাই, হত্যা, কুপিয়ে আহত করার মতো বহু ঘটনা ঘটিয়েছে নয়নের ‘বন্ড বাহিনী’। বরগুনা শহরে সে এক ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছিলো।
বরগুনা সরকারি কলেজের পিছনে তার বাড়ি। কলেজকে কেন্দ্র করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলো সে। নিরীহ পথচারী, কিংবা সাধারণ মানুষ তার এলাকা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। কলেজের অধ্যক্ষ জানিয়েছেন যে, নয়ন সরকারি বরগুনা কলেজের ছাত্র নয়। কিন্তু, সে ছাত্র না হলেও কীভাবে কলেজ ও এর আশেপাশে এ ধরনের বাহিনী গড়ে তুলছিলো তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এই বাহিনীর অন্যতম অপারেশনাল সদস্য- রিফাত ফরাজী ঘটনার আগের রাতে মেসেঞ্জারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সকাল ৯টায় কলেজ গেটে আসার নির্দেশ দিয়েছিলো। যে অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে তার ছবিসহ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।
নয়নের ‘বন্ড বাহিনী’ ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে মিলিত হয়ে অস্ত্র হাতে অতর্কিত হামলা করতো। বলা হচ্ছে- পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী এই বাহিনী রিফাত শরীফের হত্যার ঘটনা ঘটায়। অপারেশন শেষ করে তারা মিশে যায় জনমানুষের সঙ্গে। প্রথমে চন্দন ও হাসান নামে এজাহারভুক্ত দুজন এবং ভিডিও দেখে নাজমুল আহসান নামে আরো একজনসহ মোট তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর, গতকাল (২৯ জুন) রাতে সাইমুন এবং আজ (৩০ জুন) দুপুরে পুলিশের চাকরিতে পরীক্ষা দিতে আসা সাগরকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু, এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে এজাহারভুক্ত ১২ আসামির মধ্যে ১০ জনই। এর মধ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর অপরাধী নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী এবং তাদের অনুসারীরা।
বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন জানিয়েছেন, “নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে পুলিশ আগেও অভিযান চালিয়েছিলো। সর্বশেষ ২০১৭ সালে তাকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। পুলিশ তাকে বার বার গ্রেপ্তার করলেও কিছুদিন পরেই সে বের হয়ে এসেছে।”
বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি বলেছেন, “সব আসামি অবশ্যই ধরা পড়বে। আসামিদের ধরতে সব বর্ডার ও গেটেওয়েতে ইতোমধ্যে এলার্ট জারি করা হয়েছে। বাসে, লঞ্চে সর্বত্র নজরদারি ও তল্লাশি চলছে। অচিরেই তারা পুলিশের জালে ধরা পড়বে।”
প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা নয়নের গডফাদার, এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে।
নয়ন বন্ডকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ ২০১৭ সালে সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। পুলিশের খাতায় মাদক চোরাকারবারি হিসেবে তার নাম থাকলেও গত ২ বছরে থেকে সে তার নিজের বাড়িতেই মাদকের আখড়া চালিয়ে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে- উঠতি বয়সী ও বখাটেরা নিয়মিত তার বাড়িতে যেতো মাদক সেবনের জন্য।
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, জেলা পরিষদের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন পৃষ্ঠপোষকতা করেছে নয়নকে- এমন অভিযোগ বরগুনার সবমহলে। এক সময় সে তার বাড়িতেও অবস্থান করেছে বলে জানা যায়। অপরদিকে নয়নের মাদক ব্যবসায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলে সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। বরগুনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিদ্যমান দুটি বিপরীত ধারা থেকেই এই সন্ত্রাসী বাহিনীটির আশ্রয় পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
যদিও সুনাম দেবনাথ এবং দেলোয়ার হোসেন উভয়েই সাংবাদিকদের কাছে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয়রা জানান- এর আগেও রিফাতকে মারধোর করেছে নয়ন বন্ড গ্যাং সদস্যরা। শুধু তাই নয়- তৎকালীন পুলিশের এএসআই দেলোয়ার হোসেনের বাড়ির সামনে এই বখাটেরা মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধ করলে পুলিশ সদস্যের পরিবারের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়। ফলে, গ্যাং সদস্যরা পুলিশের বাড়ির আসবাবপত্র ভাংচুর করে। এই ঘটনায় মামলা ও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা দ্রুতই বের হয়ে আসে।
এই গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে তরিকুল নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও, কাউন্সিলর নান্না মিয়ার বাড়ির মোবাইলফোন ছিনতাই, ডিকেপি রোডে মেসের ছাত্রদের ব্যবহৃত ১৪টি মোবাইলফোন ছিনতাই, দোকানিকে পিটিয়ে আহত করা, বাড়িতে নিয়মিত মাদক সেবনের আড্ডা পরিচালনাসহ বিভিন্ন অপরাধের সংবাদ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়াও বরগুনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বিধাবিভক্তিও এসব কর্মকাণ্ডকে অনুকূল পরিবেশ দিয়েছিলো বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এর ফলে একটি মফস্বল শহরে বিশাল নগরীর মতোই ভয়ঙ্কর গ্যাং তৈরি হয়ে যায়। এর অন্যতম উদাহরণ নয়ন বন্ড এর ‘০০৭’ গ্যাং গ্রুপ।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদসদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু জাতীয় সংসদে বসে মোবাইলফোনে ডেইলি স্টারকে জানান, “যাদের নাম জোরেসোরে আসছে, সেই প্রতিপক্ষরা আমাদের সঙ্গে আসামিদের সংশ্লিষ্টতা প্রচার করছে। এর সঙ্গে আমাদের কোনো যোগ নেই।”
এর আগে দেলোয়ার হোসেন তার আত্মীয় রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান। এছাড়া নয়ন বন্ডের সঙ্গেও তার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
দেলোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “মাদকের সংশ্লিষ্টতার কারণে চার-পাঁচ বছর আগেই আমি আমার আত্মীয় রিফাত ফরাজীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছি। আর নয়নকে আমি চিনি না। আমার বাসায় থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এমপির ছেলে সুনাম ওর গডফাদার। আমি কোনো সন্ত্রাস ও মাদককে প্রশ্রয় দেই না। ১৯৮৫ সালে আমি অপরাধ দমনে পুরস্কৃত হয়েছি। নয়নকে পুলিশ বারবার ধরলেও সে আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। আমি শুনেছি, নয়ন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো।”
এ ধরনের ভয়ঙ্কর গ্যাং গ্রুপ কীভাবে তৈরি হলো? এটি কি রাজনৈতিক না কী পুলিশের ব্যর্থতা? এ প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন- “আমরা এখানে ব্যর্থ, আমি বলবো আমরা শতভাগ ব্যর্থ।”
সুশান্ত ঘোষ, দ্য ডেইলি স্টারের বরিশাল প্রতিনিধি
Comments