সেরা দল নিয়েও বিশ্বকাপে কেন ব্যর্থ বাংলাদেশ

একটি ছবি বিশ্বকাপের আগে ভাইরাল হয়েছিল, আরেকটি ভাইরাল হলো বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচের দিন। মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্কোয়াডের তোলা অফিসিয়াল ছবিতে ছিলেন না সাকিব আল হাসান। তার এই ‘উপেক্ষার মানসিকতা’ নিয়ে স্বভাবতই সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর। পরের ছবিতে লর্ডসে বেঞ্চিতে ম্যাচ শুরুর আগে রাজকীয় কায়দায় একা বসে আছেন সাকিব। আশেপাশে নেই কেউ।
shakib
ছবি: রয়টার্স

একটি ছবি বিশ্বকাপের আগে ভাইরাল হয়েছিল, আরেকটি ভাইরাল হলো বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচের দিন। মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্কোয়াডের তোলা অফিসিয়াল ছবিতে ছিলেন না সাকিব আল হাসান। তার এই ‘উপেক্ষার মানসিকতা’ নিয়ে স্বভাবতই সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর। পরের ছবিতে লর্ডসে বেঞ্চিতে ম্যাচ শুরুর আগে রাজকীয় কায়দায় একা বসে আছেন সাকিব। আশেপাশে নেই কেউ। দুই ছবি জোড়া লাগিয়ে কারা যেন ছড়িয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশ্বকাপের আগে-পরে মিলিয়ে আপনি চাইলে এই ছবি থেকে প্রতীকী মাজেজাও বের করতে পারেন। সাকিব আর গোটা দলের পারফরম্যান্সের চিত্র যে এমনই।

বিশ্বকাপের আগে অফিসিয়াল ছবিতে না থাকায় ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছিলেন সাকিব। বিশ্বকাপ অভিযান শেষে সাকিবের চোখ ধাঁধানো নিঃসঙ্গ লড়াইয়ের পর তার কাছে ‘দুখঃপ্রকাশ’ করলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।

৬০৬ রান, ১১ উইকেট। নিজেকে নিংড়ে এত কিছু দিলেন সাকিব। তবু দল উঠতে পারল না সেমিফাইনালে। দলের সেরা খেলোয়াড়ের জন্য অধিনায়কের খারাপ লাগা সেকারণেই। সাকিবের এমন অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্সের পরও কেন পারল না বাংলাদেশ?

খেলার মতো অবস্থায় ছিলেন না অধিনায়ক মাশরাফি

চোট জর্জর ক্যারিয়ারে ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে খেলার জন্যই মানুষের নায়ক মাশরাফি। তার অধিনায়কত্ব তুলনাহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা সাফল্য তার হাত ধরেই। মাশরাফি চোট নিয়ে খেলে যান, ছোটখাটো অনেক চোটকেই পাত্তা দেন না। এভাবে ব্যথা সয়ে দলের জন্য নিবেদনের কারণে বরাবরই তিনি প্রশংসিত। এই প্রথম বোধহয় হলো ভিন্ন। টুর্নামেন্টের মাঝে এক সাক্ষাৎকারে বলে ফেললেন, হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে কাবু তিনি। যে চোটে অনেকে হাঁটতে পারে না, সেই চোট নিয়ে খেলছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কেন খেললেন অধিনায়ক? দু-একটা ম্যাচ কি বিশ্রাম নিয়ে সতেজ হতে পারতেন না? হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট দেশে থাকতেই ছিল। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে পান আবার চোট। সেই চোট গোটা বিশ্বকাপেই তাকে ভুগিয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারকেই মাশরাফি বলেছিলেন, ‘আমার শরীর ঠিক ছিল। কিন্তু আয়ারল্যান্ডে এত ঠাণ্ডা ছিল। আমার তো মূলত সমস্যা হাঁটুতে। আয়ারল্যান্ডে যোগ হয় গ্লুটজে। ওটাও সামলানোর মত ছিল। কিন্তু ফাইনালে ম্যাচে গিয়ে চোট পাই হ্যামস্ট্রিংয়ে। ওটা আমাকে কাবু করে দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো জায়গায় এসে আর ওটা নিয়ে ভাবিনি। আমাকে ফিজিও যেটা বলছে গ্রেড-২। পরীক্ষা করা হয়নি যদিও। গ্রেড-২ হলে অনেকে হাঁটতেও পারে না। আমি খেলতে পারছি। তারমানে এক্সট্রিম পর্যন্ত আমি নিতে পারছি। তবে আমাকে ভোগাচ্ছে।'

বিশ্বকাপে এই অবস্থায় খেলেই ৮ ম্যাচে ৫৬ ওভার বল করে ৩৬১ রান দিয়ে পেয়েছেন মাত্র ১ উইকেট। তার আলো ঝলমলে ক্যারিয়ারে এতটা খারাপ সময় আর আসেনি। হ্যাঁ, ভাগ্য সহায় হলে, ক্যাচ না ফসকালে আরও গোটা দুয়েক উইকেট হয়তো পেতেন তিনি। তবু অবস্থার উন্নতি হতো আর কত!

বলের গতি কমেছে বহু আগে, কিন্তু বুদ্ধি খাটিয়ে বল করতে পারেন বলে মাশরাফির কাছে জুতসই বোলিং প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন একেবারেই মলিন। আলগা বল দিয়েছেন অহরহ। যখন চাপ দেওয়া দরকার তখন তার কাছ থেকে রান ছুটেছে দেদারসে।

এমনটা হওয়ার একটাই কারণ, খেলার মতো ফিট ছিলেন না অধিনায়ক। তার নিজের কথাতেই পরিষ্কার হয়েছে। স্ক্যান করলে যদি বড় কিছু ধরা পড়ে সেকারণে স্ক্যানও না-কি করাতে চাননি। আসল লড়াইয়ে সরে যাওয়া কখনই পছন্দ নয় মাশরাফির। কিন্তু এভাবে ‘আনফিট’ অবস্থায় খেলে গিয়ে সেরাটা যে দিতে পারলেন না! অধিনায়ক সেরাটা দিতে না পারলে দলে কতটা প্রভাব পড়ে তা নিশ্চয়ই না বোঝার কিছু নেই।

ভুল কৌশল, ম্যানেজমেন্টের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জেতার পর দল পেয়েছিল দারুণ শুরু। পরের ম্যাচে সেই মোমেন্টামে নিউজিল্যান্ডকেও বাগে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু উইকেট বুঝতে না-কি একমত হতে পারেনি দল। ব্যবহৃত উইকেটে কত রানের জন্য ছোটা দরকার তা ঠিক করা যায়নি। ২৪৪ রান করে ২ উইকেটে হারের পর আরও ২০ রানের আক্ষেপ বেড়েছে। সেই সঙ্গে টিম ম্যানেজমেন্টের একে অন্যের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতার জন্য খেদও বেড়েছে।

বড় ম্যাচে আগেই রক্ষণশীল মনোভাব

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন অধিনায়ক মাশরাফি সংবাদ সম্মেলনে সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক খেলে কাজ হবে না। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রক্ষণই হবে আসল আক্রমণ।’

ঠিক একই মনোভাব অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের বিপক্ষেও ছিল। অর্থাৎ ‘বিগ থ্রি’র বিপক্ষে তিন ম্যাচ বাংলাদেশ জিততে পারবে না আগেই ধরে রাখা হয়েছিল। ভাবনা ছিল, র‍্যাঙ্কিংয়ের নিচে থাকা আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে হবে তো বটেই, কাছাকাছি থাকা পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা- এই তিন ম্যাচ থেকে অন্তত দুই জয়। তাহলে পাঁচ জয় নিয়ে থাকা যাবে সেমির দৌড়ে। কিন্তু এমন খাপে খাপে কি সব মেলে? বৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কা ম্যাচ ভেসে যাওয়ার পরই তাই হা-হুতাশ চড়া।

এই মানসিকতাই আসলে কাল হয়েছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারার আগেই হেরে যাওয়ার মনোভাব ভর করেছে। শরীরী ভাষাতে তাই রাখা যায়নি মরিয়া ভাব। এই বিশ্বকাপে যাদের বাংলাদেশ নিজেদের সামর্থ্য থেকে রেখেছিল পিছিয়ে, সেই শ্রীলঙ্কাও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল। বিরাট কোহলিরাও বলছিলেন, এই দশ দলের যে কেউ যে কাউকে হারাতে পারে। বাংলাদেশ এই কথা মুখে বললেও মন থেকে কি বিশ্বাস করেনি?

নতুন বলে সাদামাটা বোলিং

টুর্নামেন্ট শেষ করে অধিনায়ক নিজে থেকেই বলেছেন, বোলিং আর ফিল্ডিংই তাদের ডুবিয়েছে। ৮ ম্যাচে দুবার ৫ উইকেটসহ মোস্তাফিজুর রহমান ২০ উইকেট নিয়েছেন বটে। তবে ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন ৬.৭০ করে। লিগ পর্বে সবচেয়ে বেশি ৪৮৪ রান দিয়েছেন তিনি। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন আরও খরুচে। ৭ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিতে ওভারপ্রতি তার হাত থেকে খসেছে ৭.১৮ রান। অধিনায়কের বোলিং নিয়ে আগেই আলাপ হয়েছে। পেসারদের এই অবস্থার মাঝে সাকিব আল হাসান আর মেহেদী হাসান মিরাজ ছিলেন ব্যতিক্রম, দুর্দান্ত। সাকিব ১১ উইকেট পেয়েছেন, রান দিয়েছেন মাত্র ৫.৩৯ করে। মিরাজ ৬ উইকেট পেলেও সবচেয়ে কিপটে, ওভারপ্রতি ৫.০৮ করে রান দিয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

এসব পরিসংখ্যানের বাইরে সবচেয়ে উদ্বেগের ছিল নতুন বল। বেশিরভাগ ম্যাচে (পাঁচ ম্যাচ) প্রথম ১০ ওভারে উইকেটই নিতে পারেনি বাংলাদেশ! প্রতিপক্ষকে দিতে পারেনি শুরুর চাপ। মাঝের ওভারে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেক থ্রু আনতেও বেগ পেতে হয়েছে।

বাজে-দৃষ্টিকটু ফিল্ডিং

বোলিংয়ের এসব খামতি পার করা যেত ফিল্ডিংয়ে। কিন্তু টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বাজে ফিল্ডিং দল ছিল বাংলাদেশ। ফিল্ডারদের শরীরী ভাষা ছিল দুর্বল। ক্যাচ পড়েছে, রান আউট করা যায়নি, প্রায়ই পায়ের ফাঁক গলে বল বেরিয়েছে। ডাইভ দিয়ে রান বাঁচানোর ক্ষিপ্রতারও অভাব ছিল প্রকট। এক, দুই রান আটকে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার কোনো আভাসই দিতে পারেনি বাংলাদেশের ফিল্ডিং। অধিনায়ক বলছিলেন, সবারই ছোটখাটো চোট লেগে থাকায় ফিল্ডিং হয়েছে এমন।

সেই দুই ভুল

ফিল্ডিংয়ে দুটি ভুলকে আলাদা করে তুলে ধরার কারণ, এই দুই ভুলেই দুটো বড় ম্যাচ জিততে পারেনি দল। প্রথম ভুলটি মুশফিকুর রহিমের। ২৪৫ রান তাড়ায়  ৫৫ রানে ২ উইকেট খুইয়ে চাপে পড়া নিউজিল্যান্ড দ্রুতই হারাত তৃতীয় উইকেট। তামিমের থ্রো সোজা স্টাম্পে আসছে দেখেও গড়বড় করে তা ধরতে গিয়ে কেন উইলিয়ামসনকে জীবন দেন মুশফিক। জীবন পাওয়া উইলিয়ামসনের ইনিংসই পরে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

আরেক ভুলের দায় তামিমেরই। ভারতের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে ওদের তুরুপের তাস রোহিত শর্মার লোপ্পা ক্যাচ ছেড়ে দেন তামিম। ৯ রানে জীবন পেয়ে ১০৪ করে ফেরেন রোহিত। বাংলাদেশ ম্যাচ হারে ২৮ রানে।

শেষের আগেই নেতিয়ে পড়া

ভারতের বিপক্ষে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন যখন পেটাচ্ছিলেন, আশা বাড়ছিল ভক্তদের। কিন্তু এখান থেকে জেতা যাবে, এই বিশ্বাস কি দল রেখেছিল? সাকিব আউট হওয়ার পর এই ম্যাচ আর জেতা যাবে না, এমন একটা ভাব ছিল বাংলাদেশের খেলায়। কেবল সাইফউদ্দিন চেষ্টা চালিয়েছেন। দুই ওভার আগেই অলআউট হয়ে হার ২৮ রানের। শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে কেউ টিকে থাকলে ভিন্ন কিছু তো হতেও পারত।

এই মানসিকতা অন্যভাবে দেখা গেছে পাকিস্তান ম্যাচে। যারা খেলা দেখেছেন, নিশ্চয়ই তাদের চোখে পড়ার কথা। ফিল্ডিংয়েই ক্রিকেটারদের দেখে মনে হয়েছে এই ম্যাচ তারা খেলছেন জোর করে। দুই ক্যাচ পড়েছে, গ্রাউন্ড ফিল্ডিং আগের চেয়েও বাজে হয়েছে। প্রতিপক্ষ জুটি পেলেই কেমন একটা গা ছাড়া ভাব দেখা গেছে সবার। তীব্র তাড়নাবোধের এই অভাব নিয়ে আর যাই হোক ম্যাচ জেতা যায় না। ভারতের কাছে হেরে ছিটকে পড়ায় সবাই উদ্যম রাখতে পারেননি এই ম্যাচে। তার আগের দিন অধিনায়কের অবসর নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, কেমন একটা মনমরা আমেজ ছিল গোটা দলে। শেষ ম্যাচটা জিতলেও যে ভক্ত-সমর্থকদের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর হাত থেকে বেঁচে যেতেন, এই চিন্তাও ভর করেনি।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago