চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ
দিনে দিনে কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তা না হলে কেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, একটি শিশু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে, আর কতগুলো দানবীয় হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। কোন শিশুর দিকে চোখ পড়লেই কেন মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি কি নিরাপদে থাকতে পারবে? ও কি জানে ওর চারপাশে মানুষরূপী দানবরা ঘুরে বেড়াচ্ছে? এরা আর কেউ নয় তার পরিবারের সদস্য, বা শিক্ষক বা পাড়ার ছেলে বা আত্মীয় নামক মানুষরূপী একদল জীব। মাঝেমাঝে ভাবছি খবরে চোখ রাখা কি বন্ধ করে দেব? উটপাখি হয়ে যাব? যতগুলো শিশু বা মেয়ের ছবি দেখছি, সেখানেই আমার মেয়ের বা আমার ছোট্ট নন্নার মুখ ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বাচ্চাগুলোকে আমরা হত্যা করছি।
আমার চোখের সামনে হলুদ জামা পরা সায়মার মুখ, মাথায় লাল ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা। কানে বাজছে সায়মার বাবার কান্নাজড়ানো কণ্ঠ- দেশবাসীকে একটা কথা বলতে চাই, যাদের মেয়ে বাচ্চা আছে, তারা তাদের আগলে রাখবেন। এক মুহূর্তের জন্যও আলগা হতে দেবেন না। এইসব নরপিশাচদের হাত থেকে এদের রক্ষা করবেন।
কিন্তু এভাবে তো চলা যায় না। আরও দমবন্ধ লাগছে এজন্য যে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আমি, আপনি, সমাজ, সরকার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছি না। আমি, আপনি ফেসবুকে ইমো দিচ্ছি, অধিকাংশ মানুষ নির্বিকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চুপচাপ এবং সরকার কোনো দায় অনুভব করছে না। তারা উন্নয়ন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে সারাক্ষণ সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা ভাবছে, অথচ নিজের দেশে যে ছোট ছোট শিশুরা, নারীরা অব্যাহতভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।
আমরা ভাবতেই পারি না গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত- এই ছয় মাসে সারাদেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে শিশুর সংখ্যা আট। ধর্ষণের পর এক ছেলে শিশুসহ মারা গেছে আরও ১৬ শিশু। এদের মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৪৪ জনের ওপর। এছাড়া যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৯ শিশু। যৌন হয়রানির ঘটনায় আহত হয়েছে ৪৭ মেয়েশিশু ও দুই ছেলেশিশু। মানে দাঁড়াচ্ছে ১৮২ দিনে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার। মাত্র ছয়টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে এই সংখ্যাটি পাওয়া গেছে। সারাদেশে আরও অসংখ্য নারী, মেয়ে ও ছেলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যেগুলোর খবর গণমাধ্যমে আসে, আমরা শুধু সেগুলোই জানি। বাকি সব থেকে যাচ্ছে চোখের অন্তরালে।
পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা আমাদের চমকে দিয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক, পরিবারের একদম ঘনিষ্ঠ জন কেউ বাদ নেই। আগে আমাদের ধারণা ছিল গুণ্ডা-মাস্তানরা ধর্ষণ করে তরুণী এবং কিশোরীদের। এখন দেখছি এই ধারা একেবারে পাল্টে গেছে। শিশুরাই এখন বড় টার্গেট। কারণ শিশুরা দুর্বল, শিশুদের খুব সহজে ভোলানো যায়, পথেঘাটে শিশুরাই খেলে বেড়ায় এবং শিশুরা কাউকে কোনো অভিযোগ জানাতে ভয় পায়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো শিশুরা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও তাকে গুরুত্ব দেয় না পরিবারের লোকজন। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি হয় পরিবারেরই কোনো বয়স্ক ব্যক্তি বা সদস্য। উল্টো শিশুকে চাপের মধ্যে রাখে। আমরা যদি শিশুদের ধর্ষিত হওয়ার খণ্ডচিত্রগুলো লক্ষ্য করি দেখব যে এরা কেউ বাসায় গিয়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি কখনো। এই যে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হলো, এই নুসরাত যখন তার পরিবারের কাছে বারবার এইসব নিপীড়নের কথা বলেছিল, পরিবার খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।
নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বাবা-মায়েরা যখন কাজে যায়, তখন শিশুরা থাকে একেবারে অভিভাবকহীন। দেখা যায় ১২/১৩ বছরের বোনটি তার আরও দুটি ভাই-বোনকে দেখভাল করছে। এরা সবাই অনিরাপদ। এসব পরিবারে শিশুদের নিরাপত্তার কোনো ধারণা দেওয়া হয় না। এরকম অগণিত বাচ্চা একদম অযত্নে অবহেলায় শহরের বস্তিতে বেড়ে উঠছে। এরা পথে পথে ঘুরে, হাটে-বাজারে-পথের পাশে ঘুমায়। এদের জীবনে নিরাপত্তা বলে কোনো শব্দই নেই। এই শিশুগুলোকে দেখলে আমার শুধু মনে হয় খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-বাসস্থানের পাশাপাশি এরা নিরাপত্তা থেকেও বঞ্চিত। যেকোনো সময়, যে কেউ এদের ধর্ষণ করে মেরে ফেলে রেখে যাতে পারে এবং যায়ও। প্রতিবন্ধী শিশুর নিরাপত্তা আরও কম। যাদের দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, সংসার কেউ নেয় না, তাহলে কেনইবা এদের জন্ম হয়, কেনইবা এরা ঝরে যায়?
যে শিশুটি আমাদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আছে, যে শিশুটি যত্রতত্র ঘুরেও বেড়ায় না, পরিবারেই থাকে তারও বিপদ কিন্তু কম না। এই পরিবারগুলোতেই এমন সব মানুষরূপী প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে-- যাদের কথা আমরা ভাবতেও পারব না, অথচ এই অমানুষগুলোই বাচ্চাদের সারল্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অত্যাচার করে চলেছে সবার অগোচরে। আসলে যে লোকটি বিকৃত রুচির, তার সামাজিক পরিচয় যাই-ই হোক সে কিন্তু ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেই। সে হতে পারে কারো বাবা, ভাই, চাচা, মামা বা দাদা। কিন্তু সে আসলে মনের দিক থেকে একজন ধর্ষক। সে পথেঘাটে মেয়েদের দেখে, উত্যক্ত করে আর ঘরে এসে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে। আর তাই ৯ মাসের নবজাতককে যখন তার চাচা ধর্ষণ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা দেখে আমরা আঁতকে উঠি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এরাই সেই বিকৃত মনের পিশাচ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী তাদের পরিবারেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, যখন রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়।
কেন ধর্ষণের ঘটনা দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে? সবার মুখে এখন এই একই কথা। অধিকাংশ মানুষ মনে করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলে, তারা এই ধরনের অপরাধ করতেই থাকে। অপরাধী যখন জানে অপরাধ করলে সে পার পেয়ে যাবে, তখন তার বারবার অপরাধ করতেও ভয় হয় না। দেশে নানা ধরনের যৌন উত্তেজক মাদক ও পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। সববয়সের পুরুষ এই মাদক গ্রহণ করছে এবং পর্নোগ্রাফি দেখছে এবং যার তার ওপর এর প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। মাদক এবং পর্নো সাইট দুটোই নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। সরকার যদি সত্যিই চায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে সেটা খুব কঠিন হবে না।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রচারণা চালানো। শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ। তাদের শেখাতে হবে কিভাবে তারা প্রতিবাদ করবে এবং অন্যায়কারীকে চিনিয়ে দেবে। তাদের জানাতে হবে তাদের পক্ষে আছে তাদের অভিভাবকরা। কেউ যদি আদরের নামে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে, তাকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হবে, সেটাও শিশুদের শেখাতে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে তারা যেন পরিচিত, অপরিচিত কারও সঙ্গে কোথাও একা একা চলে না যায়, কেউ কিছু খাবারের প্রলোভন দেখালে তারা যেন সেই ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে চলে না যায়। শিশুকে ঘুরে দাঁড়ানো শেখাতে হবে।
আর বাবা মা, অভিভাবককেও শিশুর নিরাপত্তার প্রতি সচেতন হতে হবে। বস্তিবাসী, দরিদ্র, অসহায় বাবা মায়েরা অনেকসময় পারেন না তাদের সন্তানের দেখভাল করতে। কিন্তু এরপরও সন্তানের কথা বিবেচনা করে খুব সচেতন হতে হবে সব অভিভাবককে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে, সন্তানের সঙ্গে কে কীরকম ব্যবহার করছে এসবে দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে সমাজ সচেতনতার কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একটি শিশুকেও আমরা সুস্থ রাখতে পারব না।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments