বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্যে ধ্বংসের মুখে একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন নদী হালদা

হালদা। বাংলাদেশের একটি নদীর নাম এই হালদা। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের নামও হালদা। এমন প্রাকৃতিক সম্পদ পেলে সারা দুনিয়া পরম যত্নে আগলে রাখত, আর আমরা হালদাকে ধ্বংসের নানা আয়োজনে ব্যস্ত। হালদা নদীর দুই পাড়ে শত শত একর জমিতে তামাকের চাষ, দুই পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাসহ নানা হুমকি তো আছেই।
বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত খালে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পোড়া ফার্নেস তেল। ছবি: স্টার

হালদা। বাংলাদেশের একটি নদীর নাম এই হালদা। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের নামও হালদা। এমন প্রাকৃতিক সম্পদ পেলে সারা দুনিয়া পরম যত্নে আগলে রাখত, আর আমরা হালদাকে ধ্বংসের নানা আয়োজনে ব্যস্ত। হালদা নদীর দুই পাড়ে শত শত একর জমিতে তামাকের চাষ, দুই পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাসহ নানা হুমকি তো আছেই।

সর্বশেষ জানা গেল, সরকারি অর্থায়নে ৯০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হয়েছে, তার বর্জ্যও হালদাকে ভয়ঙ্করভাবে দূষিত করছে। প্রমাণসহ সেগুলো উপস্থাপন করেছেন হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন। তার দাবি, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুয়াংডং পিকিং নামের যে পাওয়ার প্ল্যান্ট করছে তার ভেতরের তিন স্তরবিশিষ্ট ড্রেনেজ সিস্টেমের নিচের স্তর দিয়ে তেল মিশ্রিত পানি নির্গত হয়, যা ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার ফার্নেস অয়েলযুক্ত পানি সরাসরি হালদার পানিতে গিয়ে মিশে যাচ্ছে, যা দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে বৃষ্টি হলেই সুযোগ বুঝে বর্জ্য ফেলার কাজটি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ।

ইউএনও রুহুল আমিন দুদিন আগে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে যা লিখেছেন এবং তার যে বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে তার সারমর্ম হলো, হাটহাজারীতে যোগদানের পর থেকে তার কাছে অভিযোগ আসে, পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টসহ দুটি প্রতিষ্ঠান বর্জ্য ফেলে হালদাকে দূষিত করছে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোর্স লাগিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। দীর্ঘ নয় মাস সতর্কতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান দুটির ওপর নজর রেখে তিনি নমুনা সংগ্রহ করেন। ৯ জুলাই সোমবার সকালে খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে বর্জ্য ফেলার প্রমাণ পান। তিনি লিখেছেন, এগুলোর ছবি প্রমাণসহ প্রতিবেদন তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠাবেন। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের নামে প্রতারণা করে আসছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ১২ ধারা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্র এবং কাজ শেষে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু হাটহাজারীর ওই ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের ক্ষেত্রে অবস্থানগত ছাড়পত্র অথবা পরিবেশগত ছাড়পত্রের কোনটিই গ্রহণ করা হয়নি যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারার বিধানমতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, এ অবস্থায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের দূষণের দায়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপককে তিন কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব দিতে এবং একই সঙ্গে অনতিবিলম্বে ছাড়পত্র গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ তখনও ছাড়পত্র না নিলে ২০১১ সালের মে মাসে হালদা দূষণের দায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন প্রতিষ্ঠানটিকে। অনেক শুনানির পর একসময় মামলাটির নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু হালদা নদীতে বর্জ্য ফেলার কারণে জরিমানা আদায়ের পরও বর্জ্য শোধনাগার গড়ে তোলেনি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।

হালদা রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রামের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে বলেছেন, “এটা জঘন্য একটা বিষয়। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে চোরের মতো কাজটা করছে। যারা আছে তারাও তো যোগ্য, বিবেকবান মানুষ। তারাই একাজ করলে আমরা কোথায় যাব? তারা এতদিন মিথ্যা বলে এসেছে, অস্বীকার করেছে। এবার হাতেনাতে প্রমাণসহ পাওয়া গেছে।” তিনি বলেন, “গত বছর হালদাতে যে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তাতে সরকারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে আমরা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃক হালদা দূষণের কথা বলেছি।”

‌হালদার এই দূষণ তো নতুন নয়। এর আগে ইটিপি কার্যকর না করে তরল বর্জ্য নিঃসরণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিসাধনের দায়ে একটি পেপার মিলকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভারি বৃষ্টির রাতে এই পেপার মিল থেকে বর্জ্য ফেলা হয়।

হালদাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়ার আরও নানা ঘটনার উদাহরণ আছে। নদীর দুই পাড়ে শত শত একর জমিতে তামাকের চাষ করা হয়। তামাকের নির্যাস, চাষে ব্যবহার করা সার ও কীটনাশক মেশানো পানি সরাসরি মিশে হালদায়। এছাড়া হালদা পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি নেই। যেগুলোর আছে, সেগুলো ঠিকমতো চালু করা হয় না। প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, গৃহস্থালির বর্জ্য আরও কতো হুমকি তো আছেই। আছে বালু উত্তোলন। যেহেতু কর্ণফুলী হয়ে মা মাছ হালদায় প্রবেশ করে, তাই কর্ণফুলী না বাঁচাতে পারলে হালদা কী করে বাঁচবে?

গণমাধ্যমে জেনেছি, গত মাসেই শিল্প বর্জ্যের দূষণে বিপর্যস্ত হালদা নদীকে বাঁচানোর দাবিতে সেখানকার মানুষজন মদুনাঘাট এলাকায় মানববন্ধন করেছেন। তারা বলেছেন, কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে হালদা নদীর বিভিন্ন শাখা খালে। এসব বর্জ্য খাল বেয়ে পড়ছে হালদায়। ফলে দূষিত হচ্ছে নদী, নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য। মরছে মাছ।

হালদা নদী ও এর দুই পাড়ের জেলেদের জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন তৌকির আহমেদ। তাতেও হালদার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। দেশে বিদেশে এই চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু আমাদের বোধ কী জেগেছে?

চট্টগ্রামে বড় হওয়ার কারণে হালদা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এই নদীতে গেলে দেখা মিলবে, আকাশে চক্রাকারে উড়ছে বক, মাছরাঙ্গা, শঙ্খচিল, পানকৌড়িসহ নানান পাখি। মাঝে মাঝে নদীতে দেখা মিলবে ডলফিনের। হালদা পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার বিশেষ তিথিতে অনুকূল পরিবেশে মা মাছেরা ডিম ছাড়ে। সেই ডিম থেকে রেণু সংগ্রহ করা হয়। প্রতি কেজি রেণু থেকে চার থেকে পাঁচ লাখ পোনা জন্মায়। শোনা যায়, মিঠা পানির অতি বিপন্ন প্রজাতির ডলফিনের সংখ্যা সারা বিশ্বে ১১০০-১২০০টি। এর মধ্যে শুধুমাত্র নাকি হালদা নদীতেই আছে ২০০-২৫০টির মতো। এমন একটি নদীকে আমরা কেন ধ্বংস করে ফেলব?

স্বস্তির বিষয় হাটহাজারীর ইউএনও হালদা বাঁচানোর লড়াই করছেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য কীভাবে হালদার ক্ষতি করছে সেই প্রমাণ হাজির করার আগে হাটহাজারীতে গত এপ্রিল মাসে হালদার দূষণ ঠেকাতে অরেকটি কাজ করেছেন। ২৯ এপ্রিল এক লাখ ৬৮ হাজার লিটার ফার্নেস তেল নিয়ে ওই পিকিং পাওয়ার প্লান্টে যাওয়ার সময় একটি সেতু ধসে রেলের তিনটি বগি মরাছড়া খালে পড়ে যায়। সেই তেল যেন নদী পর্যন্ত যেতে না পারে সেজন্য স্থানীয় জনসাধারণকে নিয়ে নেমে পড়েন তিনি। হালদার গুরুত্ব যদি সবাই এভাবে বুঝতেন!

ইউএনও রুহুল আমিন দুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “আমি বিদ্যুৎ চাই হালদাও চাই। এভাবে দূষণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হালদাকে শেষ করে দিবে। ইটিপি বানানোর কথা। সেটাও নাই। বৃষ্টি মানেই হালদায় বর্জ্য ফেলে দেওয়া। রাতের অন্ধকারে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে হালদায় পোড়া ফার্নেস তেল ছেড়ে দিলে ইউএনও একা ঠেকাতে পারবে না। ইটিপি বাস্তবায়ন করে হালদার প্রতি দরদি হতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হবে।

এরকম নির্বিকার হবার সুযোগ নেই। আমরা বিদ্যুৎ ও হালদা দুইটাই চাই।

হালদা রক্ষা করে বিদ্যুৎ চাই, ধ্বংস করে নয়।

 

শরিফুল হাসান: কলামিস্ট

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Keep local realities in mind while making plans: PM to economists

Prime Minister Sheikh Hasina today asked the economists to design their policies, plans and programmes considering the local realities as advice from a foreigner will not be fruitful here.

46m ago