লালমনিরহাটে বানভাসিদের অমানবিক কষ্ট
পানি কিছুটা কমলেও এখনো জেলার প্রধান দুই নদী তিস্তা ও ধরলার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্গত এলাকা থেকে নামছে না বানের পানি। জেলার ২১টি ইউনিয়নের ৮০টি গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বানভাসি হয়ে খাবার ও পানীয় জলের সঙ্কটে অমানবিক জীবন যাপন করছেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল বলে অভিযোগ বানবাসীদের।
আজ (১৪ জুলাই) সকালে তিস্তার পানি বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
হাতীবান্ধার গড্ডিমারীতে এলজিইডির রাস্তা ভেঙ্গে আর আদিতমারীর কুটিরপাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে তিস্তা নদীর পানি হু হু করে ঢুকছে লোকালয়ে আর প্লাবিত করছে ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি। লোকজন বাড়ি-ঘর ছেড়ে গবাদি পশু-পাখি ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন।
”কুটিরপাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় পানি ঢুকে পড়ায় এখানকার শতাধিক বাড়ি-ঘর গতকাল (১৩ জুলাই) রাত থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এখনো বাড়ি-ঘর সরাচ্ছেন দুর্গতরা,” জানালেন স্থানীয় মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মজমুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের ৫০০-র বেশি বাড়ি-ঘর।
“গড্ডিমারীতে এলাজিইডির রাস্তা ভেঙ্গে তিস্তা নদীর পানি এখন হাতীবান্ধা শহরে প্রবেশ করছে। এ কারণে আমার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন,” জানান গড্ডিমারী ইউপি চেয়ারম্যান আতিয়ার রহমান।
সরেজমিনে দুর্গত এলাকার বাড়িতে বাড়িতে এখনো কোমর থেকে বুক পানি দেখা যায়। বানের পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে রাস্তা-ঘাট, নলকূপ, টয়লেট। ঠিকমতো গোসল করতে পারছেন না বানভাসিরা। আর যত্রতত্র মল ত্যাগে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে ব্যাপক। খড় ভেসে গেছে বানের পানিতে আর ঘাসের জমিগুলোও বানের পানির নিচে। গবাদিপশু পালন নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন বানভাসিরা। অনেকে স্বল্প দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি।
“আজ সাতদিন থরে পানিবন্দি জীবন যাপন করছি। কিন্তু, কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নিলেন না। পাইনি কোনো ত্রাণ সহযোগিতা। খাবার ও বিশুদ্ধর পানির সঙ্কটে আছি আমরা,”- এমনটি জানালেন তিস্তা পাড়ের কুটিরপাড় গ্রামের পানিবন্দি সোলেমান মিয়া (৬৫)। তিনি আরো বলেন, “কিছু হাঁস-মুরগি বানের পানিতে ভেসে গেছে আর বাকিগুলো বিক্রি করে দিয়েছি কমদামে।”
“বানের পানির নিচে খড়গুলো তলিয়ে আছে আবার কিছু ভেসে গেছে। ঘাসের জমিগুলোও বানের পানির নিচে। তাই গরু-ছাগল পালন নিয়ে চরম হতাশার মধ্যে আছি। কমদামে একটি গরু ও দুটি ছাগল বিক্রি করে দিয়েছি”- জানালেন হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী গ্রামে সরকারি রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া বানভাসি কৃষক নবির উদ্দিন (৬৩)।
লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী গায়দার জানান, বানভাসিদের মধ্যে ইতোমধ্যেই ১১০ মেট্রিক টন চাল, ৬,০০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ দুই লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরো ৩০৪ মেট্রিক টন চাল ভাণ্ডারে রয়েছে যা আজ বিতরণ করা শুরু হবে।
উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জয়শ্রী রানী রায় জানান, তারা নৌকায় চড়ে পানিবন্দি লোকজনের কাছে সরকারের ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “সরকারিভাবে ত্রাণের কোনো কমতি নেই। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম আমরা সুচারুভাবে মনিটরিং করছি।”
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বজলে করিম জানালেন, উজানে পাহাড়ি ঢল না থাকায় নদীর পানি কিছুটা কমলেও প্রবল বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বানের পানি নামছে না দুর্গত এলাকা থেকে। এছাড়াও, ভাটিতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে যাওয়ায় সেখানেও নামতে পারছে না তিস্তা ও ধরলার পানি।
“এই মুহূর্তে ধসে যাওয়া বাঁধ সংস্কার করা সম্ভব নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড,” বললেন বজলে করিম।
এস দিলীপ রায় দ্য ডেইলি স্টারের লালমনিরহাট সংবাদদাতা
Comments