এমন রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল আগে কেউ দেখেনি, কল্পনাও করেনি!
এমন ফাইনাল আগে কেউ দেখেনি! কল্পনাতেও বোধহয় আনেনি! টাই হওয়ায় বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়াল সুপার ওভারে। সুপার ওভারেও আলাদা করা গেল না কোনো দলকে! স্কোর সেখানেও সমান-সমান। শেষমেশ বাউন্ডারি বেশি মারার সুবাদে নিউজিল্যান্ডকে হতাশ করে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ নিল ইংল্যান্ড!
রবিবার (১৪ জুলাই) লর্ডসে টাই হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার নির্ধারিত ৫০ ওভারের ফাইনাল ম্যাচটি। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল শেষ হয় সমতায়। কিউইদের ৮ উইকেটে ২৪১ রানের জবাবে ইংলিশরাও গুটিয়ে যায় ২৪১ রানে। তাতে ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে।
সুপার ওভারে ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস ও জস বাটলার মিলে তোলেন ১৫ রান। জবাব দিতে নেমে নিউজিল্যান্ডও ঠিক ১৫ রান তোলে জিমি নিশাম ও মার্টিন গাপটিলের ব্যাটে চড়ে। তাতে ফের টাই হয় ম্যাচ!
কিন্তু নিয়ম অনুসারে, বেশি বাউন্ডারি হাঁকানোর সুবাদে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড! সুপার ওভারসহ নিউজিল্যান্ডের ১৪ চার ও ৩ ছয়ের বিপরীতে তাদের চার ২৪টি ও ছয় ২টি।
সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডের হয়ে বল করেন ট্রেন্ট বোল্ট। প্রথম বলেই ৩ রান নেন স্টোকস। দ্বিতীয় বলে সিঙ্গেল নেন বাটলার। পরের বলে দারুণ এক বাউন্ডারি তুলে নেন স্টোকস। চতুর্থ বলে সিঙ্গেল। পঞ্চম বলে ২ রান। শেষ বলে বাটলারের ব্যাট থেকে আসে আরও একটি বাউন্ডারি। ফলে স্কোরবোর্ডে মোট ১৫ রান যোগ করে ইংল্যান্ড।
এরপর নিউজিল্যান্ডের হয়ে ব্যাট করতে আসেন অফ ফর্মে থাকা গাপটিল ও হার্ডহিটার নিশাম। প্রথমেই ওয়াইড দেন বোলার জোফরা আর্চার। প্রথম বলে নিশামের ব্যাট থেকে আসে ২ রান। দ্বিতীয় বলে দারুণ এক ছক্কা হাঁকান তিনি। তৃতীয় ও চতুর্থ বলে নেন ২ রান করে। শেষ ২ বলে দরকার ৩ রানের। পঞ্চম বলে সিঙ্গেলের বেশি আসেনি। শেষ বলে দরকার ছিল ২ রানের। কিন্তু ১ রানের বেশি নিতে পারেননি গাপটিল। ডাবল নিতে গিয়ে জেসন রয়ের থ্রোতে রানআউট হয়ে যান তিনি। তাতেই পার্থক্য তৈরি হয়ে যায় ফাইনালে!
২৩ বছর পর নতুন চ্যাম্পিয়ন পেল ক্রিকেট। এমন একটি ম্যাচ শেষে বিজয়ীর হাসি হাসল ইংল্যান্ড, যেটাকে সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ম্যাচ বললেও অত্যুক্তি হবে না! ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পর ষষ্ঠ দল হিসেবে শিরোপা জিতল ক্রিকেটের জনক দেশটি। তাও আবার নিজেদের আঙিনায়। অন্যদিকে, টানা দুই ফাইনাল খেলা নিউজিল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অপেক্ষার পালা আরও দীর্ঘ হলো।
এর আগে হালকা বৃষ্টির কারণে ১৫ মিনিট দেরিতে শুরু হওয়া ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামে নিউজিল্যান্ড। তবে ইংলিশ পেসারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের বিপরীতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি তারা। নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান তোলে কিউইরা।
শুরুর দিকে মার্টিন গাপটিলের বিদায়ের পর আরেক ওপেনার হেনরি নিকোলস ও অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন মিলে ৯৮ বলে ৭৪ রানের জুটিতে নিউজিল্যান্ডকে গড়ে দেন বড় সংগ্রহের ভিত। কিন্তু বাকি ব্যাটসম্যানরা কাজে লাগাতে পারেননি সুযোগ। পাঁচে নামা টম ল্যাথামের কল্যাণে আড়াইশোর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে নিউজিল্যান্ড।
নিকোলস ৫৫, ল্যাথাম ৪৭ ও উইলিয়ামসন ৩০ রান করেন। ইংল্যান্ডের পক্ষে সফল বোলার ওকস ও প্লাঙ্কেট। দুজনেই নেন সমান ৩টি করে উইকেট। সেমিফাইনালে জয়ের নায়ক ওকসের খরচা ৩৭ রান। প্লাঙ্কেট দেন ৪২ রান। ১টি করে উইকেট দখল করেন মার্ক উড ও জোফরা আর্চার।
লক্ষ্য তাড়ায় ইনিংসের ২৪তম ওভারে দলীয় ৮৬ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। দলকে চাপে ফেলে একে একে বিদায় নেন জেসন রয়, জো রুট, জনি বেয়ারস্টো ও অধিনায়ক ইয়ন মরগান।
এরপর জুটি বাঁধেন বেন স্টোকস ও জস বাটলার। পঞ্চম উইকেটে তারা যোগ করেন ১৩০ বলে ১১০ রান। দুজনেই তুলে নেন হাফসেঞ্চুরি। এই জুটিতে মারমুখী ভূমিকায় থাকা বাটলারের অবদান ৬০ বলে ৫৯ রান।
৪৫তম ওভারে লোকি ফার্গুসনের স্লোয়ার ডেলিভারিতে বদলি ফিল্ডার টিম সাউদির হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন বাটলার। তখন বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের জন্য ইংলিশদের দরকার দাঁড়ায় ৩১ বলে ৪৬ রান। নিশ্চিতভাবে ইংল্যান্ডের দিকে হেলে পড়া ম্যাচে আসে নতুন মোড়।
একপ্রান্ত আগলে বুঝেশুনে ব্যাটিং করতে থাকা স্টোকসকে সঙ্গ দিতে পারেননি ক্রিস ওকস। এক ওভার পর ফের বল হাতে নিয়ে নিজের তৃতীয় উইকেটের দেখা পান ফার্গুসন। ওই ওভারে মাত্র ৫ রান দেন এই কিউই পেসার।
শেষ ২ ওভারে উত্তেজনার মাত্রা চরমে পৌঁছায়। ইংল্যান্ডের প্রয়োজন তখন ২৪ রান, নিউজিল্যান্ডের ৪ উইকেট। জিমি নিশামের করা ৪৯তম ওভারের তৃতীয় বলে ফিরে যান লিয়াম প্লাঙ্কেট। পরের বলেই ফিরতে পারতেন স্টোকসও। কিন্তু সীমানার কাছাকাছি তার ক্যাচ লুফে নিলেও শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে লাইনে পা ফেলে দেন ট্রেন্ট বোল্ট।
ওভারের শেষ বলে আবার উল্লাস নিশামের। উল্লাস নিউজিল্যান্ডের। ইংল্যান্ড শিবিরে পিনপতন নীরবতা। বোল্ড হন জোফরা আর্চার।
নাটকের শেষ অঙ্কটা মঞ্চায়ন হয় ম্যাচের শেষ ওভারে। ১৫ রানের সমীকরণ। ২ উইকেটের সমীকরণ। বোল্টের ওভারের প্রথম দুই বল ডট। তৃতীয় বলে ছক্কা মারেন স্টোকস।
চতুর্থ বলেও আসে ছয় রান। ভাগ্যও যে এদিন ইংল্যান্ডের পক্ষে ছিল, তার সেরা প্রমাণ এটি! মার্টিন গাপটিলের থ্রো দুই রান সম্পূর্ণ করতে ডাইভ দেওয়া স্টোকসের ব্যাটে লেগে মাঠের বাইরে চলে যায়! তাতে শেষ ২ বলে ৩ রান দরকার পড়ে স্বাগতিকদের।
কিন্তু স্নায়ুচাপ ধরে রেখে দারুণ দুটি ডেলিভারি দেন বোল্ট। ফলে দুটি বলেই একটি করে রানের বেশি নিতে পারেননি স্ট্রাইকে থাকা স্টোকস। আর উল্টো দুই বলেই ডাবল নিতে গিয়ে রানআউট হয়ে যান যথাক্রমে আদিল রশিদ ও মার্ক উড। পুরো ৫০ ওভার ওভার খেলে ইংল্যান্ড অলআউট হয় ২৪১ রানেই। স্টোকস অপরাজিত থাকেন ৯৮ বলে ৮৪ রানে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউজিল্যান্ড: ২৪১/৮ (৫০ ওভারে) (গাপটিল ১৯, নিকোলস ৫৫, উইলিয়ামসন ৩০, টেইলর ১৫, ল্যাথাম ৪৭, নিশাম ১৯, ডি গ্র্যান্ডহোম ১৬, স্যান্টনার ৫*, হেনরি ৪, বোল্ট ১*; ওকস ৩/৩৭, আর্চার ১/৪২, প্লাঙ্কেট ৩/৪২, উড ১/৪৯, রশিদ ০/৩৯, স্টোকস ০/২০)
ইংল্যান্ড: ২৪১ (৫০ ওভারে) (রয় ১৭, বেয়ারস্টো ৩৬, রুট ৭, মরগান ৯, স্টোকস ৮৪, বাটলার ৫৯, ওকস ২, প্লাঙ্কেট ১০, আর্চার ০, রশিদ ০, উড ০; বোল্ট ০/৬৭, হেনরি ১/৪০, গ্রান্ডহোম ১/২৫, ফার্গুসন ৩/৫০, নিশাম ৩/৪৩, স্যান্টনার ০/১১)।
ফল: টাই।
সুপার ওভার: টাই (বাউন্ডারি বেশি মেরে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড)।
ম্যান অব দ্যা ম্যাচ: বেন স্টোকস।
Comments