ভালোবাসার ভিখারি কমল দাশগুপ্ত
নজরুলের গানের সুর নজরুল নিজেই করতেন। তবে মাঝে মাঝে তিনি গান লিখে তা তার স্নেহধন্য কাউকে কাউকে দিয়ে সুর করাতেন। আর সেক্ষেত্রে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন তার প্রথম পছন্দ। কমল দাশগুপ্তের চেয়ে বেশি কেউ নজরুলের গানের সুর করেননি। কমল একাই প্রায় ১৫০, কারো মতে ২০০ বা মতান্তরে ৪০০টি নজরুলের গানের সুর করেছেন। নজরুলের গান অসম্পূর্ণ কমল দাশগুপ্তের সুর ছাড়া।
কমল দাশগুপ্ত ছিলেন তার সময়ের সেরা কম্পোজার। নজরুল, রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে যেয়ে, মূলত আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের ভিত্তিটা তার হাত ধরেই তৈরি হয়। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকের সুরশিল্পীদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
চিত্রা পাড়ের ছোট্ট জেলা নড়াইলের কালিয়ার বেন্দা গ্রামে ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই তার জন্ম। সব কিছু ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই। তার ছোটবেলা সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায় না। বাবার ব্যবসা উপলক্ষে তারা বেশ কয়েক বছর কুমিল্লায় অবস্থান করেন এবং কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকেই বি.কম (স্নাতক) পাশ করেন।
কমল দাশগুপ্তের সংগীতের হাতেখড়ি হয়েছিলো তারা বাবা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্তের কাছে ও পরে বড়দা বিমল দাশগুপ্তের কাছে। পরবর্তীতে তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম, কৃষ্ণচন্দ্র দে, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলে দিলীপকুমার রায়ের কাছে সংগীতের দীক্ষা নেন। আর পাশ্চাত্য সংগীতে পাঠ নেন এইচএমভির অর্কেস্ট্রা-পরিচালক নিউম্যানের কাছে। আর প্রায় শ-পাঁচেক রবীন্দ্রসংগীত শেখেন ব্রজেন গাঙ্গুলি ও অনাদি দস্তিদারের কাছে।
বড়দা বিমল দাশগুপ্ত এবং কনিষ্ঠ সুবল দাশগুপ্তও সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠিত। বড়দা বিমল দাশগুপ্তের জন্ম হয় ১৯১০ সালে। আর সুবলের ১৯১৪ সালে। তিন ভাই, তিন বোনের প্রায় সবাই সংগীত সাধনা করেছেন। শুধু কমল দাশগুপ্ত নয়, পরিবারের সকল সদস্যেই নজরুলের সান্নিধ্যে ছিলেন। কমল, বড়দা বিমল ও ছোট সুবলও নজরুলের গানে সুর করেছেন।
১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত নজরুলের কাছে তিনি সংগীতের তালিম নিয়েছেন, কাজ করেছেন সহযোগী হিসেবে। এই সময়ে তিনি মাস্টার কমল নামে নজরুল সঙ্গীতও গেয়েছেন।
দাদা বিমল দাশগুপ্তের সহকারী হিসেবে এইচএমভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে ঢুকে প্রায় ২৩ বছর বয়সে সংগীত পরিচালনা ও গানের সুর করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন কমল। যদিও গ্রামোফোন কোম্পানিতে ঢুকেছিলেন একজন তবলাবাদক হিসেবে। তিনি নিয়মিত ম্যান্ডোলিন ও জাইলোফোন বাজাতেন।
কমলের সুরে এতো বৈচিত্র্য ছিলো যে, তার সমসাময়িক কেউই তার ধারে কাছে ছিলেন না। এই সৃষ্টিশীল মানুষটি খ্যাতির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন সারাজীবন। আর সাধনা করে গেছেন সংগীতের, করেছেন একের পর এক নতুন নতুন সুরের সৃষ্টি।
ক্ল্যাসিক্যাল, সেমি-ক্ল্যাসিক্যাল, নজরুল সংগীত, শ্যামা সংগীত, গজল, কীর্তন, ইসলামী ও আধুনিক গানসহ সংগীতের মোটামুটি সব শাখাতেই রেখেছেন তার প্রতিভার স্বাক্ষর।
যূথিকা রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগমোহন মিত্র, তালাত মাহমুদ ও ফিরোজা বেগমসহ অনেকেই তার কাছ থেকে সংগীতের তালিম নিয়েছেন, সুরারোপে গান করেছেন।
মুক্তির মন্দির সোপানতলে, এনেছি আমার শত জনমের প্রেম, ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন, মেনেছি গো হার মেনেছি, পৃথিবী আমারে চায় রেখোনা বেধে আমায়, আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, দুটি পাখি দুটি তীরে, কতদিন দেখিনি তোমায়, মেনেছি গো হার মেনেছিসহ এরকম বহু জনপ্রিয় কালোত্তীর্ণ গানের সুরকার এই মহান গুণী শিল্পী।
তিনি যূথিকা রায়কে দিয়ে মীরাবাঈয়ের ভজন গাওয়ালেন। ভজন এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে মহাত্মা গান্ধী যূথিকাকে ‘মীরাবাঈ’ উপাধি দিয়ে দেন আর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় কমল দাশগুপ্তকে ‘ডক্টরেট’ উপাধি প্রদান করে।
হায়দরাবাদের নিজাম তাকে তার মসনদের গোল্ডেন জুবিলী উপলক্ষে সংগীত সৃষ্টির দায়িত্ব দেন; যে রেকর্ড নিজামের দরবারে এখনও সংরক্ষিত। ১৯৫৮ সালে তার সুরারোপিত গানের সংখ্যা সাত হাজার হওয়ায় এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি তার সিলভার জুবিলী পালন করে। প্রতিমাসে গড়ে ৪৫টি গান সুর করার কৃতিত্ব ছিল কমল দাশগুপ্তের।
তিনি বাংলা ছবির সংগীত-পরিচালক হিসেবে চারবার ও হিন্দি ছবির জন্যে একবার, মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। সংগীতের ক্ষেত্রে তার মৌলিক অবদান স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং আকারমাত্রিক পদ্ধতি ও স্টাফ নোটেশন পদ্ধতির স্বরলিপি স্থাপন।
যে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৬ সালে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা আয়কর দেন, গাড়ি ছাড়া চলতেন না, সেই কমল একটা সময় পারিবারিক সঙ্কট ও ব্যাংকের দেউলিয়াত্বের কারণে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫৫ সালে যখন কমল-ফিরোজার বিয়ে হয়, তখন কমলের বয়স ছিল ৪৩ বছর। বিয়ের চার বছর পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তার নাম হয় কাজি কামাল উদ্দিন। কমল হলেন কামাল। জীবিকার জন্যে শেষজীবনে ঢাকায় একটা মুদিখানার দোকান খুলেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এক প্রকার অনাদরে-অবহেলায়, বিনা চিকিৎসায় ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৬২ বছর বয়সে গুণী সুরকার বিদায় নেন এই নশ্বর পৃথিবী থেকে।
সারাজীবন সুরের বৈচিত্র্য দিয়ে মানুষের মন রাঙালেও কমল তার জীবনের রঙ রাঙাতে পারেননি সুরের মূর্ছনায়। যেমন পারিনি আমরা তার সুরের মূর্ছনা বুঝতে। শিল্পীর কণ্ঠের যে সুরে মানুষের হৃদয় উদ্বেলিত হয়, তার শ্রষ্ঠা অর্থাৎ সুরকার সাধারণত লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। শ্রোতারা শিল্পীকে চেনেন, জানেন না সুরকারকে। ব্যতিক্রম আছে, তবে খুব বেশি নয়। কমল দাশগুপ্ত কিছুটা ব্যতিক্রমী একজন। যদিও তার সুর করা গান যত লক্ষ-কোটি মানুষ শুনেছেন, তাদের খুব সামান্য অংশই তার নাম জানেন।
শারীরিকভাবে কমল দাশগুপ্ত এই পৃথিবীতে নেই। আছে তার সুর, যা কখনও হারিয়ে যাওয়ার নয়।
Comments