সাঁওতাল পল্লী ট্রাজেডি: ভিডিও চিত্রও প্রমাণ নয়?
গাইবান্ধায় সাঁওতালদের করা একটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে গাইবান্ধা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের যে খবর তাতে ওই মামলার মূল আসামি এবং পুলিশ, যারা সাঁওতালদের ওপরে গুলি করেছিলো এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছিলো তাদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। গণমাধ্যমের সুবাদে ওই হামলায় কারা জড়িত ছিলো তা সবাই দেখেছেন। পুলিশ আরেকটি চার্জশিট দিয়েছে সাঁওতালদের বিরুদ্ধে। সেখানে আসামি করা হয়েছে ৩৯ জনকে। যাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গুলিতে যারা নিহত-আহত হয়েছেন, এবার তারা আসামি!
সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চিত্র থাকার পরও পিবিআইয়ের তদন্তে এর প্রতিফলন না থাকার কারণ নিয়ে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মে দুই হাজার সাঁওতাল আদিবাসী এবং ভূমিহীন বাঙালিদের অস্থায়ী বসতিতে পুলিশ যে অগ্নিসংযোগ করে তার একটি ভিডিও ফুটেজ প্রচারিত হয় আল-জাজিরা টেলিভিশনে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী জানতে পারে যে সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দিয়েছিলো কয়েকজন পুলিশ এবং রংপুর সুগার মিলের কর্মচারীরা।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে গণমাধ্যমে খবর আসে যে এই ঘটনার নিজ নিজ বিভাগীয় তদন্ত করছে বিচার বিভাগ এবং পুলিশ। প্রথমে বিচার বিভাগ এবং তার পরে পুলিশ।
পুলিশের তদন্তের ভিত্তিতে গাইবান্ধার দুজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং অন্য জেলায় সংযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য ছিলেন মো. সাজ্জাদ হোসেন, যাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পঞ্চগড় জেলায় সংযুক্ত করা হয়।
এর আগে, হাইকোর্টের নির্দেশে (রিট পিটিশন নম্বর -১৪৪০২/২০১৬ এর ১৪/১২/ তারিখ) এই আগুন লাগানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দায়িত্ব পান গাইবান্ধার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহিদুল্লাহ। তিনিও তদন্ত শেষ করে কিছু সংখ্যক স্থানীয় বাসিন্দা এবং তিনজন পুলিশ সদস্যের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পান এবং হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পাঠকদের সুবিধার্থে হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং তদন্ত প্রতিবেদনের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিলো- “Snice the allegation brought against the police personnels we do not think it would be wise to give the responsibility of the inquiry to the police, thus we direct the chief judicial magistrate, Gaibandha to inquire about the matter to give a report only covering the following questions:
Who were responsible for the fire on the houses of the Santal people? And whether any police personal was involved with this heinous atrocities?”
এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে গাইবান্ধার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল্লাহ এক মাস অনুসন্ধান করে ১০৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দী, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং আগুন লাগানোর ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে তার স্বাক্ষরিত (২৯.০১.১৭) তদন্ত প্রতিবেদনে মতামত দেন এই বলে যে, “সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর জন্য স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি এবং উক্ত ঘটনার সময়ে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য দায়ী।”
“সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর ঘটনার সঙ্গে দুজন পুলিশ সদস্য ও একজন ডিবি সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত।”
পুলিশের সংশ্লিষ্টতার এই খবর তখন গণমাধ্যমে আসে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে।
কিন্তু, গত রোববার গাইবান্ধার পিবিআই পুলিশ দীর্ঘ সময় ধরে তদন্তের পর ৯০ জনকে দায়ী করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে, তাও আবার মূল আসামিদের বাদ দিয়ে।
সাহেবগঞ্জ–বাগদা ফার্মের সাঁওতাল এবং স্থানীয় বাঙালিরা রোববার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার কমিটির ব্যানারে এই চার্জশিট প্রত্যাহারের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর সড়ক পাঁচ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। তাদের অভিযোগ, অভিযোগপত্রে মূল আসামিদের বাদ দিয়ে পুলিশের ভেতরের অপরাধীদের আড়াল করেছে পিবিআই। অপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করে পুলিশ গাইবান্ধার অত্যাচারিত সাঁওতালদের প্রতি অবিচার করে তাদেরকে সুবিচার পাওয়ার পথ বন্ধ করার পায়তারা করছে।
আন্দোলনকারীদের দাবি, সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হামলা এবং লুণ্ঠনের মূল হোতা ছিলেন গাইবান্ধা-৪ আসনের সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদ।
৬ নভেম্বরের ঘটনার পর সাঁওতালদের পক্ষে থোমাস হেমব্রম গোবিন্দগঞ্জ থানায় ২৬ নভেম্বর ২০১৬–তে যে মামলা করেছিলেন সেখানে বলা হয়েছে- নাম উল্লেখ থাকা ৩৩ জন আসামি এবং আরও ৫০০ থেকে ৬০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, “সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আওয়াল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল হান্নান, ইক্ষু খামারের ম্যানেজার আব্দুল মজিদ উপস্থিত থেকে সাঁওতালদের উপর হামলাকারীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে থাকেন... এ সময় সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল এবং কাটাবারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক, পুলিশ এবং চিনি কলের শ্রমিকর-কর্মচারীরা সাঁওতালদের ওপর নগ্ন হামলা চালায়। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং লুণ্ঠন করে। পুলিশের গুলিতে পরে নিহত হন শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডু, এবং মঙ্গল মার্ডি।”
কিন্তু, পিবিআই শুধু শাকিল আকন্দ বুলবুলের নাম রেখে বাকি আসামিদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দিয়েছে। গাইবান্ধার সাঁওতালরা এই চার্জশিটের বিরুদ্ধে না-রাজি দেওয়ার এবং নতুন অভিযোগপত্রের জন্য কঠোর আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছে।
থোমাস হেমব্রমের সেই মামলায় আরও বলা হয়, প্রথমে সংসদ আবুল কালাম আজাদ এবং চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল সাঁওতালদের এই বলে স্বপ্ন দেখান যে, যেহেতু রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ভূমি অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং আখের সঙ্গে অন্য ফসল চাষ করার জন্য সুগার মিলের জমি অন্যায়ভাবে স্থানীয় কৃষকদের কাছে লিজ দিয়েছে, সেহেতু তারা তাদের বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ফিরে পাবেন। কিন্তু, এই দুজন নির্বাচনের পরে সাঁওতালদের পাশে না থেকে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এবং এক পর্যায়ে প্রশাসন এবং ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে অত্যাচার চালিয়ে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন।
সাঁওতালরা যেভাবে জমি ফেরত পায়: তদানীন্তন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র (মেমোরেন্ডাম) ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই তারিখে লিখিত এবং পঠিত হয়। ওই চুক্তিপত্রে এই বলে উল্লেখ আছে যে, ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি রংপুর সুগার মিলের ইক্ষু ফার্ম করার জন্য নেওয়া হলো। উক্ত সম্পত্তিতে ইক্ষু চাষের পরিবর্তে যদি অন্য ফসল চাষ করা হয় তাহলে অধিগ্রহণকৃত জমি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন সরকারের হাতে তুলে দিবে এবং সরকার তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবেন।
এর প্রেক্ষিতে রংপুর সুগার মিল অনেক দিন আগে থেকে চুক্তি ভঙ্গ করে স্থানীয় চাষিদের লিজ দেয় এবং তারা আখ চাষ না করে অন্য ফসল ফলাতে থাকে। যার ফলে সাঁওতাল এবং কিছু বাঙালি পরিবার, যাদের পূর্ব পুরুষরা এই জমি সরকারকে নাম মাত্র মূল্যে দিয়েছিলেন; সেই জমিতে অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করে পূর্বপুরুষদের ভিটে-মাটি ফেরত পাবার আবেদন করেন।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করে এবং সাঁওতালদের দাবির সত্যতা খুঁজে পান এবং আলেয়া খাতুন (উপসচিব) অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) গাইবান্ধা স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল সরকারের কাছে প্রেরণ করেন। যার স্মারক নং- ০৫.৫৫.৩২০০.০৩০.০০.০০১.১৫-৪১। কিন্তু সরকার সেই জমি আর আবেদনকারীদের ফেরত দেয়নি। ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। প্রথম দিকে শাকিল আকন্দ বুলবুল এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় এবং পরে সংসদ আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যায় এবং ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের ঘটনার সূত্রপাত হয়।
ওই ত্রিমুখী সংঘর্ষে যে তিনজন সাঁওতাল প্রাণ হারিয়েছেন তাদের সবার পরিবার প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, অথচ আসল অপরাধীরা আছেন দিব্বি আরাম-আয়েসে। গত বছর পরিবারগুলোর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেছি, নিহত মঙ্গল মার্ডির স্ত্রী সান্তিনা টুডু (৬০) বয়েসের ভারে নুয়ে পড়েছেন। বাড়িতে তার কেউ নেই, একা একাই থাকেন। এখন তিনি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সান্তিনা জানিয়েছিলেন, স্বামী হত্যার পরে সরকার তাকে কোনো সাহায্য করেনি। সাবেক এক বিচারপতি কিছু টাকা দিয়েছিলেন তাও নিয়ে নিয়েছেন মেয়ের জামাই। আর ফেরত দেননি।
রমেশ টুডুর মেয়ে জোসনা টুডুকে (৩২) গতবছর দেখা গেছে বগুড়ার কাহালু উপজেলার একটি ইট ভাটায় কাজ করতে। আর নিহত শ্যামল হেমব্রম এর স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন বাস করেন রাজশাহীতে।
হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরা কেউ সরকারের সাহায্য চাননি বরং চান সরকার তাদের স্বজন হত্যার বিচার করবে এবং পূর্বপুরুষের সম্পত্তির ফিরিয়ে দেবে।
মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া সংবাদদাতা
Comments