পরিচ্ছন্নতা কর্মী হবো, না দেখবো স্বজনের মৃত্যুর মিছিল

ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বাসায় আমরা খুব তৎপর। পুরো বাড়িতে নজর রাখছি কোনো ধরনের পাত্র রয়েছে কী না, যাতে পানি জমে আছে। কিছুদিন আগে বারান্দায় এসে চোখ পড়লো পাশের বাড়ির ছাদে। দেখলাম একটি কোণায় বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে। উদ্বিগ্ন হয়ে চলে গেলাম সেখানে। বাড়ির দেখাশোনা করেন যিনি তাকে বলতেই পুরো ছাদটি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ফেললেন।
dengue patient
রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর পাশে স্বজন। ছবি: শেখ এনামুল হক

ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বাসায় আমরা খুব তৎপর। পুরো বাড়িতে নজর রাখছি কোনো ধরনের পাত্র রয়েছে কী না, যাতে পানি জমে আছে। কিছুদিন আগে বারান্দায় এসে চোখ পড়লো পাশের বাড়ির ছাদে। দেখলাম একটি কোণায় বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে। উদ্বিগ্ন হয়ে চলে গেলাম সেখানে। বাড়ির দেখাশোনা করেন যিনি তাকে বলতেই পুরো ছাদটি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ফেললেন।

বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে আমাদের শহর তথা সারা বাংলাদেশের মানুষকে হতে হবে একেক জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। উদ্বুদ্ধ করতে হবে একে অপরকে।

লক্ষ্য করছি মশার ওষুধের জন্য আমরা অনেক বেশি উদগ্রীব হয়ে আছি। বিষয়টি যেনো এমন- ওষুধ এলেই সব মশা মেরে ডেঙ্গু নির্মূল করে ফেলবো। কিন্তু, বাস্তবতা ভিন্ন। ওষুধ হয়ত ২০ ভাগ মশা মারতে পারবে, কিন্তু, এর ব্যাপ্তি রয়েই যাবে। এডিসের উৎস নির্মূল করতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এটা কিন্তু নিজস্ব কোনো মতামত নয়, গত একমাস ধরে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে যে উপলব্ধি, তা-ই তুলে ধরছি।

৫ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রধান কীটতত্ত্ববিদ ডা. বি এন নাগপাল এর বক্তব্য শুনলাম। দীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এ কীটতত্ত্ববিদ ফগার মেশিন দিয়ে মশা মারার বিষয়টিতে খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। বরং পরামর্শ দিলেন এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে। প্রশ্ন হলো- এ মশার জন্ম কোথায়? এরা জন্মায় আমাদেরই আশেপাশে। আমরা যদি সামান্য পানিসহ একটি কৌটা রেখে দিই এডিস মশা সেখান ডিম পাড়বে। এমনকী, একটি পানির গ্লাসেও ডিম পাড়তে পারে। মজার বিষয় হলো- এরা সরাসরি পানিতে ডিম পাড়ে না। যেকোনো স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা অথবা পানিযুক্ত পাত্রের পানি ও শুকনো অংশের কিনারা বরাবর ডিম পাড়ে। এই লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সময় লাগে সাত থেকে ১০ দিন। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক স্ত্রী মশা ৩০ দিন পর্যন্ত বাঁচে। আশঙ্কার কথা- একটি এডিস মশার ডিম এক বছর পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। এটিকে স্থানান্তর করা হলেও নষ্ট হয় না। এর মধ্যে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যেকোনো সময়ই এগুলো লার্ভায় পরিণত হতে পারে। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অনেক। আমরা যদি সপ্তাহে একদিন একটি ঘণ্টা বের করে পুরো বাড়ি জুড়ে থাকা সমস্ত সম্ভাব্য উৎসগুলোকে ধ্বংস করি তাহলে মশার ডিম থেকে থাকলেও তা নষ্ট হয়ে যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত মার্চের এক জরিপে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা থাকে পরিত্যক্ত টায়ার, মেঝে ও ছাদে জমা পানি, প্লাস্টিক ড্রাম, পানির ট্যাঙ্ক, প্লাস্টিকের বালতি, বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র, ফুলের টব, রঙের কৌটা, টিন ও ধাতব ক্যান, প্লাস্টিকের মগ ও বদনায়। এগুলো সবই কিন্তু ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের বাসার চারপাশে। আমি যে অফিসে কাজ করি তার ৬ষ্ঠ তলা থেকে পাশের ভবনগুলোর ছাদের দিকে তাকালেই দেখা যায় কোনো কোনো প্লাস্টিকের পানির ট্যাঙ্কে ঢাকনা নেই। ফলে খুব সহজেই মশারা ডিম পাড়তে পারে, বংশ বিস্তার করতে পারে। এই পানির ট্যাংকগুলো যদি আমরা পুরনো কাপড় দিয়েও ঢেকে রাখতে পারি তাহলেও কিন্তু এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারবে না।

এডিস মশা ঘরের অন্ধকার কোণে, আসবাবপত্রের নিচে, খাটের নিচে, ঝুলিয়ে রাখা কাপড়ের ভেতরে থাকতে পছন্দ করে। এরা আলো এড়িয়ে চলে। এদের কামড়ানোর মূল সময় সূর্যাস্তের দুই ঘণ্টা আগে ও সূর্যোদয়ের পর। তাই আমরা এডিস মশার এসব জায়গাগুলোতে যদি এরোসল স্প্রে করি তাহলেই এদের মেরে ফেলা সম্ভব। ডা. নাগপালের বক্তব্য অনুযায়ী ৪০ শতাংশ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব শুধুমাত্র নির্মাণাধীন জায়গাগুলোতে যথাযথ নজরদারির মাধ্যমে। আর এই দায়িত্ব নিতে হবে সেই প্রতিষ্ঠান বা বাড়ির কেয়ারটেকারকে। তারা যদি মশার লার্ভার জায়গাগুলোতে কেরোসিন ছিটিয়ে দেন তাহলেই আর এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারবে না।

বাসডিপো, সরকারি অফিস, নার্সারি, পুলিশের যানবাহন ডাম্পিংয়ের মতো জায়গাগুলোতে মশা জন্মানোর উৎসগুলোতে যথাযথভাবে নজরদারি করতে হবে।

ভয়ের বিষয় হলো- ছোট একটি চা চামচ কিংবা আধা লিটারের একটি পানির বোতলের ঢাকনায় যতোটুকু পানি থাকে সে পরিমাণ পানিতেই মশা বংশ বিস্তার করতে পারে। তাই আমাদের সবাইকেই অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। মশার ওষুধ কবে আসবে সে আশায় বসে না থেকে একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আক্ষরিক অর্থে নিজেকে এবং অন্যকে সচেতন করে তুলতে হবে এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভাগুলোকে যেমন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে তেমনিভাবে আমাদেরকে জেগে উঠতে হবে সম্মিলিতভাবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব এ প্রাণঘাতী মশাকে নিয়ন্ত্রণ করা। তা নাহলে কীটনাশকের পর কীটনাশক আসবে কিন্তু, কোনো ফল পাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে আপনজনের মৃত্যুর মিছিল।

হেলিমুল আলম, দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Protesters stage sit-in near Bangabhaban demanding president's resignation

They want Shahabuddin to step down because of his contradictory remarks about Hasina's resignation

42m ago