ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার: উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এখনই

ছবি: শেখ এনামুল হক

তিন মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে ব্যাংকে বিল জমা দিতে এসেছেন আয়েশা খানম (ছদ্মনাম)। মাসের শেষের দিকে বিশাল লাইন। লাইনের প্রায় শেষ সারির দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আয়েশা মনে মনে দোয়া পড়তে থাকেন যাতে লাইন দ্রুত এগোয়। ভাবতে ভাবতেই কোলের সন্তানের কান্নায় চমকে উঠেন। কান্নার ধরনেই বুঝে ফেলেন ক্ষুধা পেয়েছে। কিছুক্ষণ নানাভাবে শিশুটিকে শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলেন, কোথাও যদি একটু নিরিবিলি জায়গা পাওয়া যায়! কিন্তু পুরো ব্যাংকের প্রতিটি কোণে চোখ বুলিয়েও কোথাও এমন একটু জায়গার খোঁজ মিলে না যেখানে একটু আড়াল করে স্বস্তি নিয়ে দুধপান করাতে পারেন। ওদিকে শিশুটির কান্না বাড়তে থাকায় অগত্যা বিল জমা না দিয়েই বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়ে দেন। বাসায় যেতে যেতে আয়েশা ভাবেন, কত জায়গাতেই তো স্মোকিং জোন আছে, নামাজের ঘর আছে, খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনও আছে, অথচ শিশুকে দুধপান করানোর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার নেই কেন?

আয়েশার মতো এই প্রশ্নটি আমাদের অনেকের মনের মধ্যেই জাগে। একজন মা বাইরে গেলে তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য কেন এত দুশ্চিন্তা করতে হবে? এই সুবিধা পাওয়া তো প্রত্যেক মা ও সন্তানের অধিকার। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এদেশে স্কুল, কলেজ, শপিং মল, হাসপাতাল, ব্যাংক, গার্মেন্টস, রেল স্টেশন বা বাস স্টেশনসহ পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বড় দু-চারটি হাসপাতালেই ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার চোখে পড়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের যাতায়াত বেশি হয় সেইসব জায়গায় এই সুবিধাটি প্রায় অনুপস্থিত। আর তাই ছোট শিশু নিয়ে বাইরে বের হলেই আয়েশা খানমের মতো বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।

মাতৃদুগ্ধের গুরুত্ব বোঝানোর উদ্দেশ্যে প্রতি বছর আন্তর্জাতিকভাবে ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশেও প্রতি বছর বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন করা হয়।  এই বছর ২০১৯ সালের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- “ শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে মাতা-পিতাকে উৎসাহিত করুন।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত বছরগুলোতে মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রতিটি অফিস, আদালত, শপিং মল, ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, রেলওয়ে ও বাস টার্মিনাল, শপিং মলসহ প্রতিটা জনবহুল জায়গায় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন ও আগে তৈরি করা কর্নারগুলো সচল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই নির্দেশনা ঠিকমত মানা হচ্ছে না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই।

নারীরা প্রতিদিনই বিভিন্ন কাজে কখনো একা কখনো ছোট শিশুকে নিয়ে দীর্ঘসময় বাইরে থাকছেন। ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারের অপ্রতুলতার কারণে মায়েরা উন্মুক্ত স্থানে, মার্কেটে, শপিং মলে “অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টির” শিকার হওয়ার ভয়ে শিশুকে দুধপান করানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছেন যার ফলস্বরূপ শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নিয়মিতভাবে দুধপান করালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গিয়ে প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েরা যে অবসাদে ভুগে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে, পাশাপাশি একজন মায়ের অনেক রোগের ঝুঁকি যেমন জরায়ু ক্যানসার, স্তন ক্যানসার ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আর অন্যদিকে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য যে মায়ের দুধের বিকল্প নেই তা মোটামুটি আমরা কমবেশি সবাই জানি।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উন্মুক্ত পরিসরে ব্রেস্ট ফিডিং এর সামাজিক ও আইনগত দিকটি একেক রকম। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে চাইল্ড ব্রেস্ট ফিডিং আইন আছে। সেখানে পাবলিক শৌচাগারের সঙ্গে স্বল্প পরিসরে ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা ও ব্রেস্ট ফিডিং এর ব্যবস্থা আছে। আরও ভালো দিক হচ্ছে কানাডা, জার্মানি, নরওয়ে ইত্যাদি দেশেগুলোতে উন্মুক্ত যেকোনো জায়গায় দুধপান করানোতে সামাজিক কোন বাধা নেই। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ২০১৭ সালে ভারত সরকার প্রত্যেক রেলস্টেশনে ১০০টি ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে কিছু প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে তাদের অফিসে ব্রেস্ট ফিড কর্নার প্রতিষ্ঠিত করছে। এক্ষেত্রে, ব্র্যাকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্র্যাক তার মাঠ পর্যায়ের বেশ কিছু শাখা অফিসে নারীদের জন্য ব্রেস্ট ফিড কর্নার স্থাপন করেছে।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কতৃপক্ষগণ যে কোন উদ্যোগ গ্রহণের সময় যদি সন্তানের মায়ের বিশেষায়িত এই চাহিদাকে আমলে  নিয়ে নগর ও ভবন পরিকল্পনা করতেন তবে একজন মা’কে তার সন্তানকে দুধপান করানোর মতো প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে এত ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। এক্ষেত্রে অন্য একটি বিষয়ও মনে রাখা জরুরি যে শুধু ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করলেই হবে না, সেই সঙ্গে এর গুণগত মান ও মায়েরা যাতে নিরাপদে দুধপান করাতে পারে সেটাও নিশ্চিত সাধন করতে হবে। পাশাপাশি, এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল মনোভাব গড়ে তোলাও জরুরি। সেক্ষেত্রে হয়তো স্বল্প মেয়াদে দৃশ্যমান পরিবর্তন চোখে পড়বে না কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফল অবশ্যই সবাই ভোগ করতে পারবে। কেননা, মাতৃদুগ্ধ মানেই হচ্ছে শিশুর সুস্থতা আর সুস্থ শিশু মানেই হলো সুস্থ আগামী প্রজন্ম।

 

লেখকদ্বয় ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি কর্মসূচির কর্মী

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh women defend SAFF title with 2-1 win against Nepal

Bangladesh retained the title of SAFF Women's Championship with a 2-1 win against Nepal in an entertaining final at the Dasharath Stadium in Kathmandu today. 

12m ago