আদি পরিচয় হারিয়ে সাংস্কৃতিক সঙ্কটে চা বাগানের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী
নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবন চর্চা থেকে সরে যাচ্ছে চা বাগানে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ। দারিদ্র, অসচেতনতা এবং বিচ্ছিন্নভাবে চা বাগানগুলোতে বসবাসের কারণে নিজেদের ভাষা ও কৃষ্টি জানেন না এ প্রজন্মের অনেকেই।
চা বাগানে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সহাবস্থানের ফলে ‘চা শ্রমিক’ হিসেবে তাদের পরিচয় তৈরি হয়েছে। এর জন্যে তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় পড়ে যাচ্ছে আড়ালে।
সিলেট অঞ্চলে ১৫৬টি চা বাগান রয়েছে। এসব চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালী, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশোয়ারা, বর্মা, কানু, পানিকা, কুর্মী, চাষা, অলমিক, মোদি, তেলি, পাত্র, মাঝি, রাজবংশী, মোদক, বাড়াইক, ভূমিজসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন।
এসব জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ অতিদরিদ্র হওয়ায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চা সম্ভব হয় না। নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতিচর্চা কমে আসায় নিজেদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় পড়েছে সঙ্কটে। আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেও তারা তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ধরে রাখতে পারছেন না।
চা শ্রমিকেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে সাধারণ ভাষা হিসেবে ‘ভোজপুরী’ ব্যবহার করেন। এর ফলে নিজ নিজ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্র কমে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা দেবাশীষ যাদব বলেন, “এতো কষ্টের মধ্যেও সব থেকে বেশি কষ্ট পাই যখন সমাজের একটি বিরাট অংশ আমাদের ‘ভারতীয়’ বলে মনে করে। আমাদের পূর্ব-পুরুষ যখন বঙ্গে আসেন তখন ভারতবর্ষ ভাগ হয়নি। তারা শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এসেছিলেন।”
“সবারই নিজস্ব জাতি পরিচয় থাকলেও চা শ্রমিকের সেটি নেই” উল্লেখ তিনি বলেন, “আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকলেও এখনো কোনো স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি।”
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মিরতিংগা চা বাগানের বিরাট নাযেক জানান, ছেলেমেয়েরা এখন নিজের ভাষা শিখতে চায় না। পরিবারে থাকলে দু-একটি কথা বলে। কিন্তু, বাইরে গেলে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে।
মিরতিংগা চা বাগানের মুন্ডা জনগোষ্ঠীর কমলগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির মেয়ে সাবিত্রী’র সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, “মা মারা গেছেন অনেক আগে। চা শ্রমিক বাবার অল্প আয়ে চলে না পাঁচ সদস্যের সংসার। তাই কখনো মাটি কাটা, কখনো বা ইট ভাঙার কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতে হয়।”
আরো অনেকের মতো সাবিত্রী জানেন না নিজের পরিচয়, ভাষা-কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। শুধু সাবিত্রীই নন। একই অবস্থা তার বান্ধবী দীপালী পানিকারও।
দীপালী জানান, তাদের আলাদা সংস্কৃতি কী তা তিনি জানে না। সবার সাথে যে ভাষায় (বাংলা ও ভোজপুরী ভাষায় মিশ্রণ) কথা বলেন পরিবারেও তিনি সেই ভাষাতেই কথা বলেন। নিজেদের কোনো ভাষা রয়েছে কী না তা তিনি জানে না বলেও উল্লেখ করেন।
কুলাউড়া উপজেলার মুরইছড়া চা বাগানের মলিন ওঁরাও জানান, তাদের নামের পরে উড়াং পদবী লেখা হয়। আসলে তারা ওঁরাও জনগোষ্ঠী এটি তিনি জেনেছেন কয়েকদিন আগে, তাদের সমাজের এক সভায়।
একই বাগানের সত্যজিৎ ওঁরাও জানান, ওঁরাও না উড়াং তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। টিকে থাকার জন্যে তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তাই অন্য কিছু ভাবার সময় নেই তাদের।
সাঁওতাল মেয়ে মমতা জানান, দেওরাছড়া চা বাগানে তারা মাত্র কয়েকটি পরিবার বাস করে। এখানে তারা সংখ্যায় অল্প বলে নিজেদের অনুষ্ঠানাদি তেমন হয় না। যার ফলে তারা তেমন কিছু শিখতে পারছেন না। তিনি আরো জানান, সাঁওতালি কিছু নাচ তিনি জানলেও তাদের ভাষা তিনি জানেন না।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এএফএম জাকারিয়া বলেন, “চা শ্রমিকদের আর্থসামাজিক অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে এখন অনেকে তাদের আত্মপরিচয় যেমন ভুলে গেছেন, তেমনি অনেকে আত্মপরিচয় গোপন করছেন বাধ্য হয়েই। কারণ, আত্মপরিচয় প্রকাশ করলে চা জনগোষ্ঠীর মানুষ সমাজের মূলস্রোত হবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।”
“তারা সংখ্যালঘু ও বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এবং সমাজে তাদের খাটো করে দেখার জন্য তারা ভাবেন এই সমাজে তারা গ্রহণীয় নন। তাই অনেকেই নিজেদের পরিচয় গোপন করছেন,” যোগ করেন জাকারিয়া।
বলেন, “এটা আমাদের জন্য লজ্জার। প্রায় সব সূচকেই পিছিয়ে পড়া এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সংঘটিতভাবে তাদের জীবনচর্চা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে লালন করার মাধ্যমে রক্ষা করা যেতে পাবে। আর এই দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।”
“ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে পারলে তাদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত হবে,” মন্তব্য অধ্যাপক জাকারিয়ার।
তিনি আরো বলেন, “এদের রক্ষা করতে হলে সরকারকে এখনি এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো একসময় তাদের আসল পরিচয় হারিয়ে যেতে পারে। আর এদের রক্ষা করতে না পারলে আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যও একদিন হারিয়ে যাবে।”
মিন্টু দেশোয়ারা, দ্য ডেইলি স্টারের মৌলভীবাজার সংবাদদাতা
Comments