সংরক্ষণের নামে ভেঙে ফেলা হলো ২০০ বছরের পুরনো ভবনের ছাদ

রাজশাহীর শ্রীরামপুরে জেলখানা কমপ্লেক্সের ভেতরের প্রাক উপনিবেশিক আমলে তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি ভবন ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।
হাঁতুড়ি-শাবল দিয়ে ভাঙা হচ্ছে প্রাক ঔপনিবেশিক আমলের ভবনের ছাদ। ছবি: স্টার

রাজশাহীর শ্রীরামপুরে জেলখানা কমপ্লেক্সের ভেতরের প্রাক উপনিবেশিক আমলে তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি ভবন ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে।

কোন প্রত্নতত্ত্ববিদের পরামর্শ ছাড়াই সংস্কারের অজুহাতে ইতিমধ্যেই ভবনটির ২০০ বছরের পুরনো চুন-সুরকি নির্মিত ছাদ ভেঙে ফেলা হয়েছে।    

আঠারো শতকে নির্মাণের পর থেকে ভবনটি রাজশাহীর কারাগারসমূহের উপ-মহা পরিদর্শকের বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ভবনটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় তারা এটি সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে এই সংস্কার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে ৭০ লাখ টাকা।

কর্তৃপক্ষ বলছে, ভবনটির মূল নকসা অপরিবর্তিত রেখেই সংস্কার কাজটি করা হচ্ছে। তবে তারা এ কাজের জন্য কোন প্রত্নতত্ত্ববিদের পরামর্শ নেননি।

এই ভবনটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানাতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরুল কবীর ভূঁইয়া বলছিলেন “ভবনটিতে তৎকালীন ইউরোপীয় ও বাংলার স্থানীয় স্থাপত্য শৈলীর একটি মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।”

“স্থাপত্য শৈলীদ্বয়ের মিশ্রণটি পরে সারাবিশ্বে ‘বাংলো’ নামে পরিচিতি পেয়েছে এবং এটি বাংলারই অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেব সমাদৃত,” বলছিলেন উপনিবেশিক স্থাপত্যকলা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণাকারী এই শিক্ষক।

রাজশাহীর কারাগারসমুহের উপ-মহা পরিদর্শক আলতাব হোসেন বলেছেন, ভবনটির ছাদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। ছাদ চুয়ে পানি পড়ত, ইটের টালি খুলে পড়ত।

“সংস্কার কাজে ভবনের মুল নকশার কোন পরিবর্তন করা হচ্ছে না। সংস্কারের পর ভবনটিকে আগের মতোই মনে হবে,” দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেছেন, ভবনটি পরিত্যক্ত হবার পর তারা  ডিআইজি প্রিজনসের বাসভবনের জন্য নতুন একটি ভবন নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শুধু পুরনো ভবনটি সংস্কারের অর্থ সংস্থান হওয়ায় এবং গণপূর্ত বিভাগ কাজটি বাস্তবায়ন করছে।

গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ রানা বলেছেন, ভবনটি নির্মাণের জন্য তারা একজন ঠিকাদার নিয়োগ করেছেন এবং যেহেতু ভবনটি পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা নেই, কাজেই সেটি সংস্কারের জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদদের পরামর্শের কোনো প্রয়োজন নেই।

তার দাবি, এ ধরনের ভবন সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলছেন ভবনটি যেহেতু আঠারো শতকে নির্মিত, এটি চিহ্নিত থাকুক বা না থাকুক এটি একটি অমূল্য প্রত্নসম্পদ।

ছবি: স্টার

“প্রত্নতত্ত্ববিদ ছাড়া একটি প্রত্নসম্পদের সংরক্ষণ ডাক্তার ছাড়া অস্ত্রোপচার করার মতো ঘটনা,” জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলছিলেন।

তিনি বলেন, “শুধুমাত্র একজন ডাক্তারই পারেন একটি অস্ত্রোপচার করতে। অন্য পেশার লোক মানুষের দেহে অস্ত্রোপচার করতে পারেন না। এভাবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের পরামর্শ ছাড়া ভবনটির সংস্কার করতে যাওয়াটা অবৈধ এবং এটি একটি অপরাধ।”

গত বৃহস্পতিবার ভবনটি পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা যায় যে গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদার এবং তার শ্রমিকরা হাতুড়ি-শাবল দিয়ে চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি ভবনের ছাদটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলছে।

ঠিকাদার এস এম মাহবুবুল হক রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তিনি বলেছেন ভবনটির ছাদ ভেঙে নতুন কংক্রিটের ছাদ তৈরি করবেন, ছাদের অন্য বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকবে।

তার ব্যাখ্যা, ছাদের লোহার যে পাটাতনগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল যেগুলো বাইরে থেকে দেখা যেত সেটা তারা রেখেই নির্মাণ কাজ করছেন।

কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক নুরুল কবির বলছেন, ভবনটির ছাদ ভেঙে ফেলে এর সংরক্ষণ একেবারেই অসম্ভব। “বরং ছাদটি ভাঙার কারণে পুরো ভবনটি ভেঙে ফেলতে হতে পারে।

তিনি বলেন ভবনটি যথাযথ পরিচর্যার না হওয়ার কারণেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল এবং এর যে ছাদ ছিল সেটি বর্তমান সময়ে তৈরি যেকোনো নির্মাণের চেয়ে শক্তিশালী।

তিনি বলেন, এ ধরনের ভবন না ভেঙেই সংরক্ষণের জন্য দেশে অনেক প্রশিক্ষিত প্রত্নতত্ত্ববিদ রয়েছেন যারা পরামর্শ দেবার জন্য সাগ্রহে রাজি হতেন। “কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাদের পরামর্শ ও খুব কমই চাওয়া হয়।”

“ঐতিহ্যবাহী ভবন ধ্বংসের প্রক্রিয়া রাজশাহীতে এটাই প্রথম নয়,” বলছিলেন নাগরিকদের সংগঠন রাজশাহীবাসীর আহবায়ক মাহবুব টুংকু।

তিনি জানান, ধ্বংস করা ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে রয়েছে শহরের সিএনবি মোড়ের জেলা পরিষদের ডাকবাংলো যেটি ভেঙে বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর।

মিয়াপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি ভবন, বোয়ালিয়া থানা মোড়ের দুই তলা বিশিষ্ট কো-অপারেটিভ ব্যাংক ভবন এবং ফুদকিপাড়ায় লালকুঠি ভবনও ধ্বংস করা হয়েছে, তিনি বলেছেন।

“এক ধরনের অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হয়। উন্নয়নের কথা বলে প্রকল্পগুলো থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার একটা চেষ্টা থাকে,” মাহাবুব টুংকু বলছিলেন, “আমরা সেই পদক্ষেপগুলোর প্রতিবাদ করি যার কারণে আমরা আমাদের ঐতিহ্য একের পর এক হারিয়ে ফেলছি।”

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago