তিস্তা পাড়ের কৃষক আউয়াল মিয়ার ঈদ
সকালে পান্তা ভাত খেয়ে শুরু ঈদের দিন। তিস্তা পাড়ের কৃষক আউয়াল মিয়া (৬৭) পান্তা খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজকাল সবসময় এটাও জোটে না। ঈদের আগের রাতে ৬-সদস্যের পরিবারের খাওয়ার পর কিছু ভাত অবশিষ্ট ছিল। নষ্ট না করে পানি দিয়ে রেখেছিল যেন সকালে পান্তা হিসেবে খাওয়া যায়।
দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছেন? উত্তরে আউয়াল মিয়া বলেন, ভাতের সঙ্গে ছিল ডাল, আলু ভর্তা আর শাক। রাতে হয়তো মাছ অথবা মাংস জুটতে পারে কিন্তু নিশ্চিত নন লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা পাড়ের কালমাটি গ্রামের এই কৃষক।
“গেল চার বছর ধরে কোরবানি দিতে পারছি না। কিন্তু আগের বছরগুলোতে কোরবানি দিতাম। বেশির ভাগ আবাদি জমি তিস্তা গর্ভে চলে গেছে তাই সংসারে দারিদ্র্য এখন নিত্য সঙ্গী,” জানালেন আউয়াল।
“আবাদ করেছিলাম ধান ও ভুট্টা কিন্তু দাম পাইনি কোনটিরও। ধান আবাদ করে লোকসানের ঘানি টানছি,” সঙ্গে বললেন, “ঈদের আনন্দ-খুশি আর আসে না।”
কৃষক আউয়ালের ১২ বিঘা জমির মধ্যে সাড়ে আট বিঘা এখন তিস্তার উদরে। ধুধু বালুচর। আবাদ হয় না কোনো ফসল।
ঈদের দিন সকালে স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে নামায পড়ে বাড়ির পাশে একটি বাঁশ ঝাড়ের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। প্রচণ্ড দাবদাহ তাই। নতুন জামা-কাপড়ও জোটেনি এবার ঈদে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আউয়ালের স্ত্রী আকলিমা বেগম (৬২) বলেন, বুড়াটার মাছ-মাংস খাওয়ার খুব ইচ্ছে। ঈদের দিন পান্তা ভাত দিতে গিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছি কিন্তু উপায় কী। এবার ঈদে বাড়ির কেউই নতুন জামা-কাপড় পায়নি। “এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে মাংস আসার কথা। আসলে হয়তো বুড়াটার মুখে উঠবে আর না আসলে মাংস খাওয়ার ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে,” তিনি জানান।
আউয়ালের মতো ঈদ কাটছে তিস্তা পাড়ের অন্য প্রায় সব কৃষকের। কোরবানিতে অংশগ্রহণ নেই তাদের। নতুন জামা-কাপড় তো দূরের কথা, ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে ভালো কিছু খাওয়ার আয়োজনও নেই।
“এবার কোরবানির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমার দেখা চার ভাগের এক ভাগ মানুষ এবার ঈদে কোরবানি দিচ্ছেন,” এমনটি জানালেন তিস্তা পাড়ের বাগডোরা গ্রামের কৃষক রহমত উল্ল্যাহ (৭০)। “ফসলের দাম কম, গবাদি পশুরও দাম কম, দু’দফা বন্যায় ক্ষতি এবং লোকজন কর্মহীন হয়ে পড়ায় ঈদে আনন্দ কমে গেছে,” জানান তিনি।
একই গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ (৬২) অভিযোগের সুরে বলেন যারা সরকারি চাকরি করেন ঈদ এখন তাদের আর বাকি মানুষের ঈদ হলো নিরাশার, নিরানন্দের। “আমাদের গ্রামে যে কজন মানুষ সরকারি চাকরি করে তারাই কোরবানি দিয়েছে আর ঈদ আনন্দে মেতেছে। এই চিত্র সবগুলো গ্রামের।”
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ঈদগাহ মাঠের ইমাম মাওলানা মো. সেরাজুল ইসলাম জানান, তিনি গেল বছর ১০টি গরু ও ১৫টি ছাগল কোরবানি করার দাওয়াত পেয়েছিলেন কিন্তু এবছর মাত্র তিনটি গরু ও পাঁচটি ছাগল কোরবানির দাওয়াত পেয়েছেন।
ঈদের দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত লালমনিরহাট সদর ও আদিতমারী উপজেলার আটটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে আগের মতো কোরবানি নেই। কিছু সচ্ছল পরিবারে কোরবানি হয়েছে। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাতে টাকা নেই তাই কোরবানিও নেই তাদের। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসায় বাধ্য হয়ে গ্রামের অনেক মানুষ বাজার থেকে মাংস কিনে আতিথেয়তা করেন।
এস দিলীপ রায়, দ্য ডেইলি স্টারের লালমনিরহাট সংবাদদাতা
Comments