এক কেজি রশি, ১৫ দিনের জেল ও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর দাপট
লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে বেড়িয়ে হুহু করে কাঁদছিলেন সাগর চন্দ্র নামের এক যুবক। তিনি জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা শহরের একটি রকমারি দোকানের কর্মচারী। ভ্রমমাণ আদালতের দেওয়া রায়ে ১৫ দিন জেলে থাকার পর ১৩ আগস্ট বিকালে মুক্তি পান তিনি। পরদিন বিষয়টি উত্থাপন করা হয় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়।
“আমার দোষ আমি গরিব, খেটে খাওয়া পরিবারের সন্তান। একটি দোকানে সামান্য বেতনের কর্মচারী,” এভাবে অশ্রুসজল কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাগর চন্দ্র। “আমার যদি শক্তি থাকতো, অর্থ থাকতো তাহলে আমার প্রতি অন্যায়ের বিচার প্রার্থনা করে আদালতের আশ্রয় নিতাম। কিন্তু, অসহায় আমি, নিরুপায় আমি,” জানান সাগর।
দোকান কর্মচারী সাগর চন্দ্রের অশ্রুর সঙ্গে জড়িয়ে গেলো হাতীবান্ধা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডি’র সাবেক প্রকৌশলী অজয় চন্দ্র সরকারের কিছু অস্বাভাবিক কাজকর্মের চিত্র। তিনি গেলো ১৪ জুলাই চাকরি থেকে অবসর নেন। তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় পাটগ্রাম উপজেলার এলজিইডি প্রকৌশলীকে। কিন্তু, চেয়ার ছাড়েননি অবসরে যাওয়া অজয় চন্দ্র সরকার। প্রকৌশলীর চেয়ারে বসে নিজেই ঠিকাদারি কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৯ জুলাই অজয় চন্দ্র স্থানীয় রাজেন বাবুর রকমারি দোকান থেকে ২৫০ টাকা দরে এক কেজি প্লাস্টিকের রশি কিনেন। বাকিতে রশি কিনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, বাকি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন অজয়।
প্লাস্টিকের রশি নিম্নমানের তাই ৩০ জুলাই বিকালে সাবেক সেই প্রকৌশলী ভ্রমমাণ আদালতের সহযোগিতা নেন। ভ্রমমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সামিউল আমীন ওই দোকানে অভিযান চালান। উদ্ধার করা হয়নি কোনো রশি। দোকানের মালিকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভোক্তা অধিকার আইনে ১৫ দিনের জেল দেওয়া হয় দোকানের কর্মচারী সাগর চন্দ্রকে। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করে সাগরকে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সামিউল আমীন জানান, “রশিগুলো ছিলো নিম্নমানের। প্লাস্টিকের রশি হলেও এর ভিতরে ছিলো কাগজ। দোকানে উপস্থিত দোকান কর্মচারী সাগর চন্দ্রকে পাওয়া গেছে তাই আদালত তাকেই সাজা দিয়েছেন।”
সাবেক এলজিইডি প্রকৌশলী অজয় চন্দ্র সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের সংস্কার কাজে রশির প্রয়োজন ছিলো তাই তিনি রশি কিনেছিলেন। কাজ করার সময় এসব নিম্নমানের রশি ছিঁড়ে কয়েকজন রং শ্রমিক মাটিতে পড়ে আহত হয়েছিলেন।
উপজেলা সংস্কারের কাজে যে রশি কেনা হয়েছিলো তা কি সরকারি টাকায় কিনেছিলেন?- “হ্যাঁ, সরকারি টাকায় কেনা হয়েছিলো।”
কতো টাকা বরাদ্দে কী ধরনের মেরামত কাজ হচ্ছে আর এ কাজের ঠিকাদার কে?- এমন প্রশ্ন করলে অনেকক্ষণ চুপ থেকে তিনি উত্তর দেন- “এটা এখন বলা যাবে না।”
তার কাছে আবারো বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে বরাদ্দের পরিমাণ আর কাজের বর্ণনা না বলে স্থানীয় ওয়ার্কশপ মালিক আলম হোসেনের নাম উল্লেখ করে বলেন, তিনি ঠিকাদার আর ঠিকাদারই সবকিছু জানেন।
আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন যে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। অজয় চন্দ্র সরকার তার কাছ থেকে শুধু লাইসেন্সের কপি নিয়েছেন। “কোন কাজ, কতো টাকার কাজ এবং এটা কোথায় হচ্ছে এমন কোনো কিছুই আমার জানা নেই,” আলম জানান।
আপনার লাইসেন্স ব্যবহার করে কোনো কাজ করা হলে এবং সেই কাজে অনিয়ম হলে তো আপনি বিপদে পড়বেন। তা কি জানেন?- “হ্যাঁ, জানি। আমার লাইসেন্সকে কালোতালিকাভুক্ত করা হবে। কিন্তু, যারা লাইসেন্স কালোতালিকাভুক্ত করবেন লাইসেন্সতো তাদের হাতেই।”
এবার এলজিইডি’র সাবেক প্রকৌশলী অজয়কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উচ্চস্বরে বলেন যে তিনি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন তাই কাজের ব্যাপারে কোনো তথ্য তার কাছে নেই। অবসরে যাওয়ার পর আপনি এখনো প্রকৌশলীর চেয়ারে অবস্থান করছেন কীভাবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কিছু কিছু কাজ অবশিষ্ট আছে। সেগুলো সই-স্বাক্ষর করতে হয় তাই চেয়ারে বসা হয়।”
অবসরে যাওয়ার পরও সই-স্বাক্ষর দেওয়া যায় কী না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অবসরে যাওয়ার তারিখের আগের তারিখ উল্লেখ করে সই দেওয়া যায়। কিন্তু, অবসরে যাওয়ার পরের তারিখে সই দেওয়া অবৈধ।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সামিউল আমীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “কতো টাকা বরাদ্দে কী ধরনের কাজ হচ্ছে এটা আমার জানা নেই। প্রকৌশলী অজয় চন্দ্র সরকার এ ব্যাপারে সবকিছু জানেন আর তিনি নিজেই তা মনিটর করছেন।”
কাজের বরাদ্দ ও ধরন নিয়ে লুকোচুরি অনুসন্ধান করতে গিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলো, আলম হোসেনের লাইসেন্স ব্যবহার করে সাবেক প্রকৌশলী অজয় চন্দ্র সরকার নিজেই ঠিকাদারের কাজ করছেন। সরকারি চেয়ারে বসে তিনি ঠিকাদারি করছেন, অভিযোগ সর্বমহলে।
এস দিলীপ রায়, দ্য ডেইলি স্টারের লালমনিরহাট সংবাদদাতা
Comments