নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে মিয়ানমারে ফিরতে চায় না রোহিঙ্গারা
“মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করা যায় না। এর আগেও তারা অনেকবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। তাই সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান করলেই আমরা ফিরতে পারি,” এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য চূড়ান্ত তালিকায় থাকা রোহিঙ্গা নারী জয়নব বেগম।
মিয়ানমার সরকারের প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থা রোহিঙ্গাদের মাঝে গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর ধরে নিজ জন্মভূমি রাখাইন রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বাস করতে বাধ্য করা হয়েছে রোহিঙ্গা জনগণকে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাদের বেশিরভাগই মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বর্বর অভিযান থেকে জীবন বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর চুক্তি সই করে। পরে দুই দেশ ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামে চুক্তি করে।
‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ অনুযায়ী, প্রত্যাবাসন শুরুর দুই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিলো।
রোহিঙ্গাদের প্রথম দলের ফেরার কথা ছিলো গত বছরের ১৫ নভেম্বর। কিন্তু রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি না হওয়ায় এ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
এদিকে মঙ্গলবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যবস্থা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ বা মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষে উপযুক্ত নয়। মিয়ানমার এই অবস্থার উন্নতি বা সংকটের মূল কারণ সমাধান করার জন্য কিছুই করেনি বলে অভিযোগ করেছে তারা।
এইচআরডব্লিউর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, “মিয়ানমার এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বর নির্যাতন ও সহিংসতার কোনো সমাধান করতে পারেনি। সুতরাং রোহিঙ্গারা ফিরে গেলেও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।”
এদিকে মঙ্গলবার বিকালে শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা কিছু রোহিঙ্গা বিভিন্ন দাবি তুলে ধরে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে ক্যাম্পের ইনচার্জ এম খালিদ হোসেন বলেন, “কোনো বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেনি।”
রোহিঙ্গাদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য কয়েক দশক ধরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। এইচআরডব্লিউ বলছে, রাখাইন রাজ্যে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের কোনো মৌলিক স্বাধীনতা নেই।
বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে আগামীকাল ২২ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর দিন। চূড়ান্ত ওই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে মঙ্গলবার টেকনাফের ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পে তাদের সাক্ষাৎকার নেয় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচিআর।
কিন্তু আবারও শর্তের বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যখন জোরদার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে এমন মুহূর্তে রোহিঙ্গারা আবারও প্রত্যাবাসনের নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। রোহিঙ্গারা বলছেন, “শর্ত পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যাবেন না।”
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তৎপর রয়েছে প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্র। সাধারণ রোহিঙ্গারা অনেকটা জিম্মি তাদের কাছে। অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
সরেজমিনে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কিছু শর্ত রয়েছে, যা মানলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি রয়েছেন। অন্যথায় তারা ফিরবেন না। এমনকি গুলি করে মেরে ফেললেও তারা শর্ত পূরণ ছাড়া ফিরতে রাজি নন।
এনভিসি কার্ড নয় সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরত, কারাগারে বন্দী রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা, ধর্ষণের বিচার, অবাধ চলাফেরা, নিরাপত্তা প্রদানসহ একাধিক শর্ত পূরণ না হলে স্বদেশ ফিরে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন তারা।
মঙ্গলবার ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ ও ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে জানিয়ে দেয় ২২ আগস্ট স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বার্তা। এসময় অনেক রোহিঙ্গা ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকে এসব শর্ত জুড়ে দেন।
প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা শালবন ক্যাম্পের এ-ব্লকে বসবাসকারী মো. জুবাইর বলেন, “ইউএনএইচসিআর-এর একটি প্রতিনিধি দল সকালে এসে পারিবারিক ডাটা কার্ড খুঁজে। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কিছু জানায়নি। পরে জানতে পারি প্রত্যাবাসনের তালিকায় আমার নাম রয়েছে।”
মিয়ানমারের বুচিডং চাংচিপ্রাং এলাকার জুবাইর স্বদেশে ফিরবেন কী না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেন, “নিজের দেশে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে আছি। নাগরিকত্ব, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, অবাধ চলাফেরা ও নিরাপত্তা দিলেই ফিরবো। এভাবে গেলে মরণ নিশ্চিত। এর চেয়ে এদেশে মৃত্যুই ভালো হবে।”
জুবাইরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তালিকায় থাকা হাসিনা বেগম বলেন, “স্বামী-সন্তানদের নিরাপত্তা কে দিবে? ওখানে নিয়ে আমাদের আশ্রয় শিবিরে রাখবে। অবাধ চলাফেরা করা যাবে না। রোহিঙ্গা স্বীকৃতি দেবে না। তবে কি নিয়ে আমরা স্বদেশ ফিরবো?”
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে এগিয়ে নিতে ইউএনএইচসিআর ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করেছে। লিফলেটে স্বদেশ ফিরে গিয়ে কোথায়, কীভাবে রাখা হবে এবং পরবর্তীতে কী কী করণীয় সে সম্পর্কে ধারণা রয়েছে।
টেকনাফ নয়াপাড়া শালবাগান ক্যাম্পের (নং- ২৬) ইনচার্জ মো. খালিদ হোসেন জানান, প্রত্যাবাসনের তালিকায় আসা ২১ পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিদেরও নেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসনের জন্য সবকিছু প্রস্তুত রয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বলেন, “প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্য আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা আশাবাদী ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন হবে। পাশাপাশি সকাল থেকে ইউএনএইচসিআর-এর লোকজন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাতকার নিচ্ছে এবং এসব লোকজনকে সংশ্লিষ্টরা নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।”
Comments