শিক্ষা নয়, জাবির আলোচনার বিষয় ‘২ কোটি টাকা’র ভাগ-বাটোয়ারা

শিক্ষাবিষয়ক কোনো সংবাদ নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বর্তমানে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘দুই কোটি টাকা’।
কেটে ফেলা গাছ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষাবিষয়ক কোনো সংবাদ নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বর্তমানে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘দুই কোটি টাকা’।

এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার ক্যাম্পাস উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দিবে না, এই প্রতিশ্রুতিতে ছাত্রলীগ নেতাদের দেওয়া হয়েছে ২ কোটি টাকা- এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় গত ২৩ আগস্ট থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রকল্পের ঠিকাদারদের কেউই সরাসরি মুখ খুলছেন না।

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের কমপক্ষে ১০ নেতা-কর্মী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের তিনটি অংশকে দেওয়া এক কোটি টাকার ভাগ তারাও পেয়েছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানা যায়, বাকি ১ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারা পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইতিমধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য বহু গাছ কেটে ফেলায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন এই মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বিচারিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, নিজেদের মধ্যে ১ কোটি টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে ছাত্রলীগের নেতারা উপাচার্যের বাসভবনে বৈঠকে করেন। ঈদুল আজহার আগে গত ৯ আগস্ট সেই বৈঠক হয় এবং সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিলো।

এ বিষয়ে জানার জন্য গত ২২ আগস্ট সাংবাদিকরা উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি অভিযোগটি উড়িয়ে দেন।

গত ২৪ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনার অভিযোগ ভিত্তিহীন।

তিনি বলেন, “ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার ব্যাপারে কথা বলতে সংগঠনটির সভাপতিসহ অন্যরা আমার কাছে এসেছিলেন। তার মানে এই নয় যে, এখানে অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “অন্য সংগঠনগুলোর মতোই বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগ আমার কাছে আসে। গত পাঁচ বছরে আমি তাদের অনেক সমস্যার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যার কারণে এখানে কোনো তৃতীয় পক্ষের উত্থান ঘটেনি।”

তিনি জানান, তার প্রশাসনের কেউই ছাত্রলীগের সঙ্গে অর্থ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে জড়িত নন।

উপাচার্য এড়িয়ে গেলেও ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র ওই বৈঠকের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

JU trees
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রস্তাবিত ছাত্র হল তৈরির জন্যে গাছ কাটা চলছে। ছবি: সংগৃহীত

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, ছাত্রলীগের এমন এক নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে বৈঠক হয়। ছাত্রলীগের তিনটি অংশের চার নেতাসহ উপাচার্যের সঙ্গে তার পরিবারের দুই সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কে কতো টাকা পাবে সে বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে দর কষাকষি হয়েছিলো।”

“অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সভাপতি ৫০ লাখ, সাধারণ সম্পাদক ২৫ লাখ এবং তৃতীয় পক্ষ ২৫ লাখ করে টাকা পাবে”, বলেন তিনি।

এই তিন অংশের একটির নেতৃত্বে রয়েছেন জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল রানা, অপর অংশের নেতৃত্বে সাধারণ সম্পাদক এসএম আবু সুফিয়ান চঞ্চল এবং তৃতীয় অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং সহসভাপতি নাঈমুল হাসান তাজ।

ছাত্রলীগের এই তিন অংশের বিরোধের জেরে হওয়া সংঘর্ষে গত ১০ মাসে কমপক্ষে ক্যাম্পাসে সাতবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটি রক্তক্ষয়ী সংঘের্ষে অন্তত ১৫০ জন আহত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বাধীন অংশটি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি এবং তৃতীয় অংশটি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী বলে জানা গেছে।

প্রথমদিকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পুরো এক কোটি টাকা অর্ধেক করে ভাগ করে নেবেন। কিন্তু, গত ৭ আগস্ট তৃতীয় অংশের নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে বৈঠক করার পর হিসাব পাল্টে যায়।

একমতে পোঁছতে তিন অংশের নেতারাই পরে ৯ আগস্ট উপাচার্যের বাসায় বৈঠকে মিলিত হন।

বৈঠকে তৃতীয় অংশের প্রস্তাব ছিলো যে, যেহেতু তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী, সেহেতু তাদের এক কোটি টাকার অর্ধেক দিতে হবে। তবে জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

পরে উপাচার্যের মধ্যস্থতায় বিষয়টি ‘নিষ্পত্তি’ হয় বলে বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়।

জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল রানা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে স্বীকার করলেও, টাকা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোনো আলোচনায় অংশ নেননি বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “অভিযোগটি সত্য নয়। কেউ কি বলতে পারবে যে আমরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, তাদের কাজ থামিয়ে দিয়েছি? আমরা তাদের সহায়তা করছি যাতে কাজটি সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে।”

জাবি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক এসএম আবু সুফিয়ানের সঙ্গে কয়েক দফা চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং সহসভাপতি নাঈমুল হাসান তাজ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তাছাড়া, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে বেশ কয়েকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি এবং সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

জাবির পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নে’ ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রথম পর্যায়ে সম্প্রতি ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

নির্মাণ প্রকল্পের জন্য সবুজ ক্যাম্পাসটির প্রায় ১ হাজার ১৩২টি গাছ কেটে ফেলার জন্য চিহ্নিত করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

জাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, “বিপুল পরিমাণ টাকা ভাগ-বাটোয়ারার খবর শুনে আমরা  বিস্মিত হয়েছি।”

এই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা উন্নয়ন চাই, কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই প্রকল্প তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছি।”

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে Tk 2cr now talk of JU ক্লিক করুন

আরো পড়ুন:

জাবি ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দল ও সংঘর্ষের নেপথ্যে ৪৫০ কোটি টাকার নির্মাণ কাজ

জাবিতে চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনার ‘মাস্টারপ্ল্যানে’ গোড়ায় গলদ!

Comments

The Daily Star  | English

Abu Sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago