উপাচার্য নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে দুর্নীতি, দৃষ্টিকটু আমোদ, প্রশাসনিক ব্যাপারে অযাচিত উপস্থিতি, নানারকম হস্তক্ষেপের হরেক রকম গল্প বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিভিন্ন কোণা থেকে বাতাসে ভাসলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই সমস্ত কথা কখনোই মানতে চাননি। বরং বারেবারে তার সন্তান ও স্বামীর পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন।
ju protest
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানার নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের প্রতিবাদ। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে দুর্নীতি, দৃষ্টিকটু আমোদ, প্রশাসনিক ব্যাপারে অযাচিত উপস্থিতি, নানারকম হস্তক্ষেপের হরেক রকম গল্প বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিভিন্ন কোণা থেকে বাতাসে ভাসলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই সমস্ত কথা কখনোই মানতে চাননি। বরং বারেবারে তার সন্তান ও স্বামীর পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন।

উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ শিক্ষকরা নানা সময়, নানাভাবে উপাচার্যের স্বামী ও সন্তানের কাজের সাফাই গেয়েছেন। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে, উপাচার্যের স্বামী-সন্তানের পক্ষে উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ শিক্ষকদের গাওয়া সাফাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতোদিন বিশ্বাস করে আসছিলেন, অন্তত সাফাই গাওয়া ব্যক্তিদের ওপর ভরসা-আস্থা থাকার কারণে। পরিস্থিতির কারণে গত কিছু দিনে সাফাই গাওয়া ব্যক্তিদের সাফাই গাওয়া কমেছে, মানুষের আস্থাটুকুও আর নেই।

আগে থেকে চাউর হয়ে থাকা দুর্নীতির অভিযোগগুলো একে একে গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে উপাচার্যের পরস্পর বিরোধী মন্তব্যের কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা উপাচার্য দিতে পারেননি। প্রকাশিত সমস্ত সংবাদকে তিনি মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন- এসব কিছু হচ্ছে তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। যদিও সব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বললেও এখন পর্যন্ত উপাচার্যের কোনো কথায় আস্থা-বিশ্বাস রাখার মতো কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য যখন একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে পাল্টা-পাল্টি বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন, উপাচার্য অস্বীকার করলেও অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত নেতারা যখন অভিযোগ স্বীকার করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন, তদন্তের দাবি করেন এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উপাচার্যের কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না; তখন নৈতিকভাবে সেই উপাচার্যকে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দ্বিধাহীনভাবে বলছেন- নৈতিকভাবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম উপাচার্য হিসেবে আর থাকতে পারেন না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান রিভাইস ও একনেকে অনুমোদিত ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই টেন্ডার ছিনতাই এবং পরবর্তীতে কাজ শুরু হওয়ার অল্প কয়েকদিনের মাথায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং বিদ্রোহী অংশের নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে গড়ে ওঠা আন্দোলনের দীর্ঘ ঘটনাপ্রবাহের পর, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তোলা পদত্যাগের দাবির প্রতি-উত্তরে উপাচার্য বলেছেন- সবাই যদি চায় তবেই তিনি পদত্যাগ করবেন। যারা তাকে এই পদে আসীন করেছেন তারা যদি না বলেন তবে প্রতিদিন গালমন্দ খেয়ে হলেও তিনি দায়িত্ব পালন করে যাবেন। আন্দোলন যারা করছেন তাদের বাইরেও অনেকেই আছেন। আন্দোলনকারীরাই একমাত্র অংশীজন নয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের দীর্ঘ সময়ে ধীরে ধীরে এর যৌক্তিকতা সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনদের মধ্যে যেমন প্রোথিত হয়েছে, তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের কর্মসূচীতে সব অংশীজনদের প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ এবং শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে এই নৈতিক আন্দোলন তীব্রতর হয়েছে। আন্দোলনের আহুত বিভিন্ন কর্মসূচীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্রসংগঠন, শিক্ষকদের সবগুলো ফোরাম, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জোটসহ সব বিভাগ ও ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি উপাচার্যের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে যথেষ্ট।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কাঠামো অনুসারে সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একজন উপাচার্য নির্বাচিত হয়ে আসার কথা থাকলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য সিনেট প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেননি বিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালনা কাঠামোর প্রতিও তিনি দায়বদ্ধ নন। ছোট্ট প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও ঝুলে থাকে উপাচার্যের নিয়োগকর্তাদের ইশারার অপেক্ষায়। কার্যত অচল হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালনা পর্ষদ। ইতিমধ্যে সিনেটের রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিরাও উপাচার্যের প্রতি অনাস্থা এনেছেন এবং এর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

উপাচার্যের নিয়োগকর্তারা উপাচার্যের নিয়োগের আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কোনো মহলের মতামত নেননি এবং উপাচার্যও ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনকে পাশ কাটিয়ে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছেন। মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করার তিন বছরের দীর্ঘ সময়েও কোনো মহলের সঙ্গে কথা না বলা, মতামত না নেওয়া, মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যস্ত করা, হল স্থানান্তরের দাবির মতো বিষয়গুলোতে একগুঁয়ে মনোভাব ত্যাগ করার জন্য বারবার আহ্বান জানানোর পরেও উপাচার্য কখনো তাতে গুরুত্ব দেননি। শিক্ষার্থীদের যদি তিনি গুরুত্ব দিতেন, শিক্ষকদের পরামর্শ আমলে নিতেন তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

ঘটে যাওয়া দুর্নীতির ঘটনায় পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মধ্য দিয়ে নিষ্কলঙ্ক ঘোষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন কেন্দ্র পরিদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানালেও আন্দোলনকারীদের অজ্ঞাতে, একান্ত অনুগত ও আস্থাভাজনদের নিয়ে গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কেন্দ্র পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছেন উপাচার্য। আন্দোলনকারীদের এড়াতে চুপি চুপি কেন্দ্র পরিদর্শন উপাচার্যের নৈতিক পরাজয়েরই নামান্তর।

আমরা উপাচার্যকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সহযোগিতা করতে আগ্রহী থাকলেও, বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তার অপসারণের দাবিতে আমরা লড়াই জারি রাখবো, গালমন্দ আমরা উপাচার্যকে করবো না।

লেখক: সংগঠক, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনোপ্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

5h ago