বাংলাদেশের ক্রিকেটে জৌলুসের অন্তরালে কালিমা
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্রমেই অর্জন করছে যশ-খ্যাতি। দেশের সাধারণ জনগণের কাছেও এর আবেদন অনন্য, অন্য কিছুর সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ফলে উদীয়মান ও তরুণ ক্রিকেটারদের অভিভাবকদের কাছে টেকসই পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে ক্রিকেট।
তবে দুঃখজনক এবং একইসঙ্গে শঙ্কার ব্যাপার হলো, এদেশে ক্রিকেটের যে জৌলুস আর চাকচিক্য তার অন্তরালে রয়েছে কালিমা আর নানা রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি! এই দ্বৈত চরিত্র প্রতিফলিত হয় দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিসিবি) কার্যকলাপে। ক্রিকেটের মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একে অন্ধকারে ঠেলে দিতেও জুড়ি নেই বোর্ডের। বিসিবির গুটিকয়েক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি যারা আবার প্রচুর ক্ষমতাবানও, তারা মাঠ এবং মাঠের বাইরে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বিতর্ক তৈরি করেছেন-বিতর্কিত হয়েছেন। ফলে ক্রিকেটকে ঘিরে অভিযোগ বিস্তর!
গেল দুই-তিন বছরে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটকে, বিশেষ করে নিচের স্তরগুলোকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর পেছনে দায়ী বোর্ডের ওই সকল কর্তারা। তারা বিভিন্ন ক্লাবের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থেকে আম্পায়ারদের কাছ থেকে নানা সময়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেছেন। ম্যাচ চলাকালে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য করেছেন। এতে ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের উদীয়মান প্রতিভাদেরও খেলাটির প্রতি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় আসর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ তার জাঁকজমক বেশ আগেই হারিয়েছে। ঘরোয়া কাঠামোর নিচের স্তরগুলোর হাল যে তলানিতে গিয়ে ঠেকছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই যেমন, বুধবার (২ অক্টোবর) বেশ নিরবে-নিভৃতে শেষ হয়েছে ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের দুই দিনব্যাপী খেলোয়াড় দলবদল। মিরপুরে ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) প্রাঙ্গনে ছিল না কোনো উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা।
এবারের মৌসুমের লিগে অংশ নেবে ২০টি ক্লাব। সবগুলো দলই দলবদলে অংশ নেয় এদিন। সবমিলিয়ে ১৯৫ জন ক্রিকেটার নিবন্ধন সম্পন্ন করেন। তবে এই আসরকে ঘিরে অনিশ্চয়তার কালো মেঘের ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল আলি হোসেনের চোখে-মুখে। তিনি ইন্দিরা রোড ক্রীড়া চক্রে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
শঙ্কা থাকাটাই স্বাভাবিক আলির জন্য। খেলার পাশাপাশি মোহামেডান ক্রিকেট অ্যাকাডেমির সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করা এই ক্রিকেটার গেল মৌসুমে ছিলেন দ্বিতীয় বিভাগের দল মাতুয়াইল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। চুক্তি হয়েছিল ৩ লাখ টাকার। কিন্তু মাত্র অর্ধেক পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি। আর লিগের মাঝপথেই তাকে ক্লাব ছাড়তে হয়েছিল।
এবার আলি ফিরেছেন প্রথম বিভাগে। ক্লাব পর্যায়ে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ। ১২ বছর ধরে খেলছেন। কিন্তু আগের ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তার জাল থেকে বের হতে পারেননি তিনি, ‘আমার বয়স এখন ত্রিশের কাছাকাছি। আমি পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার জন্য পড়াশোনা ছেড়েছি। কিন্তু আমার আয় না বাড়লে খেলা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। গেলবার ভালো পারিশ্রমিকের আশায় আমি দ্বিতীয় বিভাগে খেলেছিলাম এবং ক্লাবটির প্রথম বিভাগে উঠে আসার মতো যথেষ্ট সম্ভাবনাও ছিল।’
তিনি যোগ করেন, ‘কিন্তু সুপার লিগ শুরু হওয়ার পর যখন ক্লাব কর্তারা বুঝতে পারল যে, প্রথম বিভাগে আমরা উঠতে পারছি না, তখন তারা দুর্ব্যবহার শুরু করল। তারা আমাদের বাকি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে আরও দুই ক্রিকেটারের সঙ্গে আমিও লিগের মাঝপথে ক্লাব ছেড়ে দেই।’
প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি আলোচিত বিষয় হলো- ‘সরকারি দল’! বিসিবির ক্ষমতাশালী কর্মকর্তাদের দলগুলোকে এই নামেই ডেকে থাকেন অংশ নেওয়া ক্রিকেটাররা। এই ‘সরকারি দল’গুলো আম্পায়ারদের সাহায্য তো পায়-ই, এমনকি লিগের আয়োজকরাও তাদের পক্ষে কাজ করে থাকে। এটা যেন ‘ওপেন সিক্রেট’!
খুব শিগগিরই এসব অভিযোগের সুরাহা হওয়ার কিংবা অসামঞ্জস্যকে তাড়িয়ে বিদায় করার আশা বেশ ক্ষীণ। তারপরও তাকিয়ে থাকতে হবে বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপনের দিকে। তিনি অবশেষে ঘরোয়া ক্রিকেটের বেহাল কাঠামোর দিকে নজর দেবেন না-কি কালিমার অন্তরালে জৌলুসকে হারিয়ে যেতে দেবেন?
Comments