শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই গন্ডগোল

যদি কেউ বলে সাংবাদিকতা না করলে কী হতে? বলতাম শিক্ষক। কারণ তারা আলোকিত মানুষ তৈরি করেন। আর তাই সুযোগ পেলেই আমি ক্লাসে ছুটে যাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে।

যদি কেউ বলে সাংবাদিকতা না করলে কী হতে? বলতাম শিক্ষক। কারণ তারা আলোকিত মানুষ তৈরি করেন। আর তাই সুযোগ পেলেই আমি ক্লাসে ছুটে যাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে।

আজকে শিক্ষক দিবসে সত্যিকারের শিক্ষকদেরকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা। খুব সহজে যেখানে মাথা নত করি না সেখানে আমার স্কুল কলেজের শিক্ষকদের পা ছুঁয়ে সালাম করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিকারের শিক্ষকদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু গত ৪৮ বছরে যেই পেশায় নিয়োগে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে তার একটা শিক্ষক।

প্রথমে সরকারি স্কুল আর কলেজের কথায় আসি। সরকারি কলেজে বিসিএস থেকে শিক্ষক আসেন। সরকারি প্রাইমারি বা মাধ্যমিকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মাঝে মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস হলেও পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, যদিও সেখানে স্বজন প্রীতি তদবির যে একেবারেই হয়নি বলা যাবে না। কিন্তু বেসরকারি স্কুল আর কলেজের শিক্ষক নিয়োগে সেটা ভয়াবহ রকমের যাচ্ছেতাই অবস্থা তৈরি করেছে। বিশেষ করে এমপিওভুক্তির নামে। 

গত বছরের মার্চে সে সময়ের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছিলেন, এমপিওভুক্তি শিক্ষা ব্যবস্থাকে চরমভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে-ই টাকা দিয়েছে সে-ই নিয়োগ পেয়েছে। গণহারে স্কুল তৈরি ও শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। যোগ্যতার মাপকাঠি বিচার করা হয়নি। এর কুফল এখন আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।

আসাদুজ্জামান নূর ঠিক বলেছেন। ব্যতিক্রম থাকতে পারে কিন্তু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, গত দুই তিন দশকে যারা আর কোনো চাকরি পাননি তারাই হয়তো তদবির আর টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক হয়েছেন।

এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আসি। এক যুগ সাংবাদিকতা করার কারণে খুব কাছ থেকে শিক্ষক নিয়োগগুলো দেখেছি। সংবাদ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক আনুগত্য থেকে শুরু করে তদবির, অর্থ লেনদেন এগুলো এখন শিক্ষক নিয়োগে নিয়মিত ঘটনা।

ভেবে দেখেন, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ প্রক্রিয়া যতটা স্বচ্ছ হয়েছে, যত বেশি মেধাবীরা এখানে নিয়োগ পাচ্ছে সেই তুলনায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দিনকে দিন অস্বচ্ছ হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। কারণ একজন অযোগ্য লোক শিক্ষক হওয়া মানে তার ৩০ থেকে ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীবনে হাজার ছেলেমেয়ে কষ্ট পাওয়া।

শুধু নিয়োগ নয়, নিয়োগের আগে পছন্দের প্রার্থীকে প্রথম, দ্বিতীয় বানাতে যতো কাণ্ড ঘটে সেগুলো লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। বলছি না ব্যতিক্রম নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিটা মোটেও স্বচ্ছ নয়।

আপনারা কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন তিন চারটা প্রথম শ্রেণি পাওয়া লোকজনও তো নিয়োগ পাচ্ছে। একমত। কিন্তু যত মেধাবীই হোক, তাদেরও নিয়োগের আগে বাধ্য হয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় কারও না কারও কাছে যেতে হয়েছে। বিষয়টা ভীষণ লজ্জার। একজন শিক্ষককে নিয়োগের আগেই মেরুদণ্ড বাঁকা করতে হয়েছে। এভাবেই একজন শিক্ষক তার স্বকীয়তা হারান।

আরেকটা বিষয় হলো উপাচার্য নিয়োগ। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা ভিসিদের কাণ্ড কীর্তি দেখছি। সেটা বোধ হয় এখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। গোপালগঞ্জের সদ্য বিদায়ী ভিসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো শিক্ষক হিসেবে যে কারও জন্য লজ্জার। আবার একজন ভিসি কেন লিফট দেখতে যাবেন সেটাও বিস্ময়ের।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের জীবন-কাহিনী নিয়ে সম্প্রতি অধ্যাপক লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটা কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, ভাইস চ্যান্সেলরের পদটি এক ধরনের পুরস্কার। যারা খাঁটি শিক্ষাবিদ তারা এই পুরস্কারের যোগ্য নন। যারা চুটিয়ে শিক্ষক রাজনীতি করেন, যারা তদবির করেন শুধু তারা এই পুরস্কারের যোগ্য প্রার্থী।

জাফর ইকবাল লিখেছেন, ভাইস চ্যান্সেলররা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ইচ্ছে তাই করেন। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, প্রভোস্ট বিভিন্ন কেন্দ্রের পরিচালক জাতীয় অনেক অর্থকরী পদ থাকে। ভাইস চ্যান্সেলর নিজের ক্ষমতা বলে সেগুলো বিতরণ করেন। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের দল থাকে, সব দলের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের এরকম অর্থকরী পদ দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে ফেলা যায়। চাটুকার জাতীয় শিক্ষকেরা মুখবন্ধ রাখেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিগুলো ভাইস চ্যান্সেলরের মুখের কথায় উঠে বসে। এভাবে আত্মসম্মানহীন শিক্ষকেরা দেখতে দেখতে কেঁচোর মত হয়ে যান।

কথাটা এখানেই। একজন শিক্ষক মেরুদণ্ড উঁচু করে বাঁচবেন। কেন তাকে কেঁচোর মত হয়ে বাঁচতে হবে? এই যে কেঁচোর জীবন সেটা শুরু হয় নিয়োগ থেকেই। কেন মেধাবী ছেলে মেয়েকে নিয়োগের আগে উপাচার্য থেকে শুরু করে নেতাদের কাছে ছুটতে হবে? এটা তো তার জন্য চরম অসম্মানের। এই প্রক্রিয়া কে বন্ধ করবে?

নীতি নির্ধারকদেরও বিষয়গুলো ভাবতে হবে। এই যে দিনের পর দিন অযোগ্য লোকজন শিক্ষক হচ্ছেন, তদবিরে শিক্ষক হচ্ছেন তার ফল কিন্তু আমরা পাচ্ছি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ১৮শ’ শিক্ষক। তারা কত জন সত্যিকারের শিক্ষক? আপনারা যারা শিক্ষক তারা বলেন তো, আপনার স্কুলের শিক্ষককে বেশি সম্মান করেন নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে?

আপনারা কেউ কেউ বলতে পারেন এর সমাধান কী? বহু আগেই সমাধান বলেছি। শুধু নামমাত্র একটা ভাইভা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নাটক বন্ধ করা উচিত। এর বদলে যারা শিক্ষক হতে চায় তাদের সবার একটা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হোক। এরপর তাদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হোক। যারা পাস করবে তাদের সবাইকে এরপর ক্লাসে পাঠানো হোক। প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স প্রতিটা ক্লাসে একবার যাক। ক্লাস নিক। এরপর পাঁচ বর্ষের তিন-চার শ ছাত্র ছাত্রী তাদের নম্বর দিক। শিক্ষার্থীরা যাদের প্রথম দ্বিতীয় হিসেবে নম্বর দেবে তারাই হোক শিক্ষক।

শুধু যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের মূল্যায়নের সুযোগ রাখা উচিত তাই নয়, প্রতি বছর প্রত্যেক কোর্স শিক্ষকের মূল্যায়ন করুক ছাত্ররা। গবেষণা আর এই মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী থেকে পদোন্নতি সবকিছু হোক। তাতে জবাবদিহিতা তৈরি হবে। স্বজনপ্রীতি, দলীয় নোংরামি কমবে। দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা তখন নিজেরাও পড়বেন ছাত্রদেরও পড়াবেন।

শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রতিটা ধাপেই শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটা সুন্দর ও স্বচ্ছ করা উচিত। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠিক করার পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোও থাকা উচিত যাতে সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো শিক্ষকতায় যায়। আজকে একজন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের বেতন অনেক সরকারি দপ্তরের অফিস সহকারী বা পিয়নের চেয়ে কম। তাহলে কেন একজন সরকারি প্রাইমারির শিক্ষক হবেন? আর প্রাইমারির ভিতটা ঠিক না হলে পরে আর কী হবে?

কেউ এ কথায় কষ্ট পেলে ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠিক করতে না পারলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। এর বদলে কে ভিসি হবেন, কে ডিন হবেন, কে প্রভোস্ট হবেন এই লড়াই চলতেই থাকবে। গবেষণা আর শিক্ষার বদলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চর দখলের মতো মারামারি শুরু হবে। ছাত্রনেতাদের সামলাতে দিতে হবে চাঁদা। রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধনে একেক জন উপাচার্য হয়ে উঠবেন স্বেচ্ছাচারী।

আজকে শিক্ষক দিবসে সবাই স্মরণ করতে পারি শহীদ শিক্ষক অধ্যাপক শামসুজ্জোহার কথা। তিনি তার ছাত্রদের বলেছিলেন, “কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে”। কথাগুলো তি‌নি শুধু বলার জন্য ব‌লেন‌নি, স‌ত্যি স‌ত্যি যখন উর্দি পরা লোকজন গু‌লি চালাল তিনি আগে নিজের বুক পেতে দিলেন।

অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯-এর ভেতরে শহীদ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তিনি তার ছাত্রদের রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কথাটা যতবার ভাবি, যতবার কল্পনা ক‌রি ততবার শ্রদ্ধা জাগে। জানি এখনো অনেক শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থীদের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। আগলে রাখেন। আলোর পথ দেখান। মানুষ তৈরি করেন। আজকে শিক্ষক দিবসে সত্যিকারের সেইসব শিক্ষককে শ্রদ্ধা।

 

শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
interim government's dialogue with BNP

Reforms ahead of polls: BNP waits with cautious optimism

Having weathered a very difficult 15 years as de facto opposition, the BNP now wants only the essential reforms done to ensure free and fair polls.

14h ago