লালন দর্শন

একজন লেখক, কবি বা দার্শনিক কি লিখেছেন তা যদি ভালোভাবে বুঝতে চাই, তবে অবশ্যই ওই ব্যক্তির যাপিত জীবন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। জানতে হবে আসলে তিনি কী রকম সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বা কী রূপ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। তার আলোকেই যদি লালনের যাপিত জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে তার দর্শন আসলে তার জীবন-অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন।

একজন লেখক, কবি বা দার্শনিক কি লিখেছেন তা যদি ভালোভাবে বুঝতে চাই, তবে অবশ্যই ওই ব্যক্তির যাপিত জীবন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। জানতে হবে আসলে তিনি কী রকম সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বা কী রূপ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। তার আলোকেই যদি লালনের যাপিত জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে তার দর্শন আসলে তার জীবন-অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন।

ব্যক্তিজীবনে জাতি-ধর্মের সঙ্গে সংঘাত এবং সমাজ থেকে বার বার বিচ্যুতি তার দর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। যদিও লালনের কাজের ধারাবাহিকতা নির্ণয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু, হিন্দু এবং মুসলিম সমাজ থেকে তার বার বার বিচ্যুতি, তার কাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। বস্তুত, লালনের ব্যক্তিজীবনে সমাজের এই আঘাত তাকে প্রয়োগবাদের দিকে ধাবিত করেছে। জীবদ্দশায় তিনি একাধিকবার হিন্দু এবং মুসলমান সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন- যা তাকে মানবজীবন সম্পর্কে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। যদিও তার মুসলিম এবং হিন্দু- উভয় সমাজে বসবাসের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তিনি উভয় সমাজ ব্যবস্থার ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে নিজের চিন্তা-চেতনাকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

লালন নিজেই বলেছেন যে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি তার সন্দেহ রয়েছে।

লালন তার দর্শনকে পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসের বাইরে গিয়ে একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নেন এবং তার শৈশবের দীক্ষাগুরু সিরাজ সাঁইয়ের দেখানো পথে অগ্রসর হন।

সন্দেহ প্রবণতা এবং জিজ্ঞাসাবাদ

অতীতের প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাসের প্রতি লালন শাহ সব সময় সন্দেহ পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন যে অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠান আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছি এবং কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই তা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছি যেগুলোর সত্যি কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। কিন্তু, লালন এসব প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এবং আচার-প্রতিষ্ঠানের উপর প্রশ্ন করতে শুরু করেন এবং তা যাচাই-বাছাই করে গানের মাধ্যমে তার দর্শনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। যেমন-

গান-১

যিনি রাজাদের রাজা

তিনি আবার চোরেরও রাজা

তাহলে আমি এখন কার কাছে অভিযোগ দিব?

তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন যে প্রশ্ন করা খারাপ বিষয় নয়, বরং প্রশ্ন করতে শিখলে কোনোকিছু অনুধাবন করার শক্তি আরও প্রখর হয়। যখন কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তুলে এবং সন্দেহ পোষণ করে তখন ওই ব্যক্তির নিজস্ব সত্তা ওই বিষয় বা ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে অংশগ্রহণ করে যা তার চিন্তার প্রখরতা বাড়ায়।

একটি বিষয় বা ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায় বলে লালন মনে করতেন। যেমন কার্ল মার্ক্সের বস্তুবাদ অনুযায়ী অবজেক্ট বা বস্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি। লালন জ্ঞানের পরিবর্তন এবং বিবর্তনে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করতেন। তার মতে, জ্ঞানও সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়।

লালন দর্শনের উৎস

লালনের গান বিশ্লেষণ করে আমরা তার চিন্তার ধরন সম্পর্কে জানতে পারি। ইউরোপ, এশিয়াসহ সারা পৃথিবীতেই প্রাচীনকাল থেকে দর্শনশাস্ত্র অনেকগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করে। কিন্তু, লালন সেগুলোর একটিও অনুসরণ না করে বরং নিজের অজান্তেই অনেকগুলো পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। লালন তার দর্শনের প্রাথমিক স্তরে যৌক্তিক প্রশ্নানুসন্ধান করেন যার শেষ হয়েছে প্রয়োগবাদ, সচেতন বিশ্লেষণ এবং আত্মিক বিনিয়োগবাদের মাধ্যমে। লালনের ওই তত্ত্ব মতে, একজন তখনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবেন যখন তিনি তার নিজেকে সর্বোচ্চ আত্মার সঙ্গে মিলাতে পারবেন, আলিঙ্গন করতে পারবেন।

 

মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া সংবাদদাতা

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago