চারটি বুলেটও দমাতে পারেনি জামালের স্বপ্ন
সাত বছর আগে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন থেকে এসে বাংলাদেশের ফুটবলে পা রেখেছিলেন জামাল ভূঁইয়া। বাংলাদেশের প্রবাসী বাবা-মার সন্তান ইউরোপ ছেড়ে এখানে খেলতে এসেছেন , খবরের রসদ ছিল এইটুকুতেই। বিরূপ পরিবেশে প্রথমবার ট্রায়ালে টিকতেও পারেননি, সেসব ছাপিয়ে সেই তিনিই এখন বাংলাদেশের ফুটবলের বড় এক নায়ক। কিশোর বয়সে এএফসি কোপেনহেগেনের যুবদলের হয়ে গোল আছে তার, বিখ্যাত সেই ক্লাবের মূল দলে খেলারও হাতছানি ছিল। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা বদলে দেয় জামালের কক্ষপথ। কোপেনহেগেনে গোলমালের মাঝে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে কোমাতেও চলে গিয়েছিলেন। জীবণ মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে জামাল এখন দিচ্ছেন বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন জীবন।
আরও কিছু গণমাধ্যমের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশ অধিনায়কের গল্প শুনেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আতিক আনাম।
ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে-পরে ভারতের কিছু লোক বোঝাতে চাইল আপনি বাংলাদেশি নন, কারণ আপনার বাংলা উচ্চারণ স্পষ্ট নয়, এগুলো কী পীড়া দেয়?
জামাল ভুঁইয়া: আমার বাবা-মা দুজনই বাঙালি। বিষয়টা যেমন মেসুত ওজিল, সামি খেদিরা, থিয়াগো আলকানতারার মতো। আমি মোটামুটি পাঁচ ভাষায় কথা বলতে পারি-সুইডিশ, ড্যানিশ, নরওয়ে, ইংলিশ এবং বাংলা। বাবা-মা বাড়িতে বাংলায় কথা বলত। কিন্তু আমি এখানে এসে বেশি বাংলা শিখেছি। যদিও ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলি; কিন্তু যোগাযোগে কোনো সমস্যা হয় না।
আপনার বাবা-মা ডেনমার্ক কবে গেলেন, পরিবারের গল্প কিছু বলুন।
জামাল: আমার দাদা খুশি ভূঁইয়া ১৯৬৩ সালে ডেনমার্ক যান, ১৯৬৭ সালে যান আমার বাবা আর ১৯৭১ সালে যান মা। আমার বাবার ফেবব্রিক ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি ছিল। তারপর তিনি একটা সুপারমার্কেট কিনলেন, যা তিন দশক ধরে চালাচ্ছেন। আমার জন্ম, বেড়ে উঠা কোপেনহেগেনে। আমার বড় দুই ভাই ডেনমার্কেই থাকে।
এফসি কোপেনহেগেনের যুব দলের হয়ে গোল করেছিলেন, নিশ্চয়ই খুব ভালো স্মৃতি আছে?
জামাল: হ্যাঁ খুব বিশেষ কিছু ছিল। এফসি কোপেনহেগেন ডেনমার্কের সেরা দল, আমি বরাবর ওখানে খেলতে চেয়েছি। আমি গোল করলাম, দুদিন পর এফসি কোপেনহেগেনে সই করলাম। তখন আমার বয়স ১৪।
আপনি কি সব সময়ই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে আসছেন? এই পজিশন বেছে নেওয়ার কারণ কি?
জামাল: জানি না,আমার আসলে ভাল লাগত। স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম।
এফসি কোপেনহেগেনের যুব দলে খেলার সময় তো বাজে একটা ঘটনা ঘটে আপনার জীবনে। সেই গুলির ঘটনা খুলে বলুন।
জামাল: ২০০৭ সালে যখন আমার বয়স ১৬/১৭, তখন আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। যে এলাকাটায় আমি বেড়ে উঠেছি, সেটা খুব ভালো ছিল না, কিন্তু যেহেতু আমি সেখানে বেড়ে উঠেছি, নিরাপদ অনুভব করতাম। ওই দিন একজন বলল, দ্রুত বাড়ি ফিরে যাও, কিন্তু আমি বিপদটা উপলব্ধি করতে পারিনি। কয়েক মিনিট পর চারটি গুলি খেলাম। একটা লাগল কনুইয়ে, একটা পেটের নিচের দিকে, দুই শরীরের দুই পাশে। কোমায় ছিলাম দুই দিন। হাসপাতালে ছিলাম তিন/চার মাস।
তারপর? আবারও ফুটবল খেলার কথা ভেবেছিলেন কি?
জামাল: না। ভেবেছিলাম ফুটবল ছেড়ে দিব। ডেনমার্কের ফুটবল খুব উঁচু পর্যায়ের। মনে হয়েছিল আমাকে দিয়ে আর হবে না, ভেবেছিলাম লেখাপড়াটা ভালোভাবে চালাব। বিষয়টি নিয়ে আমার যুব দলের কোচ জনি লারসনের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি পরামর্শ দিলেন চেষ্টা (ফুটবল) করার। আবার খেলা শুরু করলাম। দুর্ঘটনার সাত মাস পর। ১৪ কেজি ওজন ঝরালাম ওই সময়ে।
সেই স্মৃতি কি এখনও তাড়া করে ফিরে?
জামাল: সবসময় এটা আমার জন্য দুঃখের স্মুতি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সবকিছুর জন্যই আলাদা পরিকল্পনা আছে। হয়তো ওই দুর্ঘটনা ছিল আমার দুর্ভাগ্য। অবশ্যই সেই স্মৃতি অনেকবারই আমার দুঃস্বপ্নে ধরা দিয়েছে। ভাবতাম, যদি সেদিন আমি ওখানে না থাকতাম, না যেতাম। ওই ঘটনা আমার ফুটবলের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। ওই সময় কোপেনহেগেনের যুব দলে আমি সেরা খেলোয়াড় ছিলাম। ক্লাব আমাকে সিনিয়র টিমে চাচ্ছিল, অন্য দলও আগ্রহ দেখাচ্ছিল। শুরুতে আমি অনেক কাঁদতাম, কিন্তু বিষয়টা আমাকে মেনে নিতে হয়েছিল।
যখন বাংলাদেশে এসে ট্রায়াল দিলেন এবং প্রথমবার নির্বাচিত হলেন না, সময়টা কতটা কঠিন ছিল?
জামাল: এটা ২০১১ সালের কথা। কোচ সাইফুল বারী টিটো আমার কিছু ভিডিও দেখার পর ই-মেইল করলেন। যখন বাংলাদেশে এলাম। কাউকে চিনতাম না। শুরুতে একটু জড়তা ছিল আমার। ডেনমার্কে ফিরলাম এবং পরে যখন এলাম, তখন শুধু নিজেকে এবং ফুটবল নিয়ে ভাবতাম। গণমাধ্যম ও খেলোয়াড়রা আমাকে নিয়ে যা-ই বলত, কিছু মনে হতো না। আমি ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। এরপরই তো যাত্রা শুরু হলো।
আপনার বাংলাদেশে চলে আসা নিয়ে বাবা-মার প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
জামাল: বাবা বলতেন, তোমার বাংলাদেশে যাওয়া উচিত এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। ফুটবল ক্যারিয়ার শেষের আগে বাংলাদেশের জন্য যা কিছু করেছে তার জন্য সন্তুষ্ট হও। কিন্তু মা খুব চিন্তিত থাকতেন। বললেন, কেন তুমি ডেনমার্কে থাকছ না, পড়াশোনা চালাচ্ছো না।
২০১৩ সালে অভিষেকের পর নিজের কি কি উন্নতি চোখে পড়ে?
জামাল: আমি এখন ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারি। সেট পিস ভাল নিতে পারি। বল নিয়ে ভাল খেলতে পারি। খেলাটাকে সব মিলিয়ে পড়তে পারি ভালো। প্রতিদিন অনুশীলনের পর আমি নিজে নিজে ১০-১৫ মিনিট আলাদা ট্রেনিং করি। আমার খাদ্যভাস বদলেছে। আমি মিষ্টি খাই না, কুক গিলি না।
২০১৮ সালে জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার পরের জামাল কেমন?
জামাল: অধিনায়ক হওয়ার প্রভাবটা এরকম যে, সিদ্ধান্ত নিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা করি। যাচাই-বাছাই করি। যখন মাঠে থাকি, আমাকে কথা বলতে হয়, সতীর্থদের নির্দেশনা দিতে হয়। আগে এ দায়িত্ব আমার ছিল না। যখন আপনি অধিনায়ক, এটা ভিন্ন রকম। আপনাকে খেলোয়াড়দের বলতে হবে-এটা করো, এটা করবে না। এমন বলতে হয়-এটা না মানলে জরিমানা করব। যেগুলো অধিনায়ক হওয়ার আগে কখনই বলতে হয়নি। এবং আমি জানি, যদি দল হারে তাহলে আমি থাকব আক্রমণের প্রথম সারিতে!
এখন তো অনে নাম ছড়িয়েছে। সময়টা কতটা উপভোগ করছেন?
জামাল: জানি না। সত্যি বলতে আমি টিভি দেখি না। পত্রিকা পড়ি না। জানি না বিষয়টা কিভাবে বলব। শুধু বলতে পারি, আমি খুশি যে আমার পারফরম্যান্স মানুষের ভালো লাগছে।
অধিনায়ক হওয়ার পর নিজের পারফরম্যান্সে উন্নতিও হয়েছে বলে মনে করেন?
জামাল: হ্যাঁ। শুধু আমি নই, দলও বদলেছে। আমি অধিনায়ক হওয়ার পর নতুন এবং তরুণ খেলোয়াড় এসেছে দলে। জেমি ডেও অনেক পরিবর্তন করেছেন। সে আর সব কোচের মতো নন, যারা নিজেদের দরকারি বিষয়গুলো বাফুফেকে বলতে কিছুটা ভয় পায়। জেমি এটা সবসময় সরাসরি বলে।
জেমি আর কি বদল এনেছে?
জামাল: শৃঙ্ক্ষলা, ডায়েট, ফিটনেস, নিয়মিত চেক-আপ এগুলো জেমি যোগ করেছে। আমরা যে কৌশলে খেলি সেটাও পুরোপুরি ভিন্ন। সে জানে খেলোয়াড়দের শক্তি, দলের দুর্বলতা। সে তরুণ কোচ এবং এর আগে ফুটবল খেলেছে। ফুটবলারদেরকে সে অনুভব করে। বোঝে।
লডভিক ডি ক্রুইফের অধীনেও অনেক ম্যাচ খেলেছেন। যার আসলে পজিশন ভিত্তিক ফুটবল দর্শন ছিল। যেখানে জেমির দর্শন রক্ষণ পোক্ত রেখে প্রতি আক্রমণ। এটা আপনি কীভাবে দেখেন?
জামাল: হ্যাঁ ক্রুইফের অধীনে বল পজিশন রেখে খেলার ব্যাপার ছিল। কিন্তু রক্ষণাত্মক কৌশলে জেমি ফল আনছে। দিনশেষে ফলটা ম্যাড়ার করে।
গত ১৪ মাসে আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের উন্নতির জায়গা কোনগুলো?
জামাল: আমরা খুব বেশি গোল হজম করিনি। কিভাবে রক্ষণ সামলাতে হয়, তা আগের চেয়ে ভালো জানি। জেমির কারণে আমরা আগের চেয়ে অনেক অনুশীলন করি, কিভাবে রক্ষণ সামলে আক্রমণ করা যায়, জানি।দলের মধ্যেও এখন অনেক বেশি প্রতিযোগিতা হয়। এখন আমাদের ২২ থেকে ২৬ জন খেলোয়াড় আছে, যারা সবাই শুরুর একাদশে খেলার যোগ্যতা রাখে। এই যেমন, বিশ্বনাথ ঘোষ বেশ কিছু দিন শুরুর একাদশে ছিল, এরপর রায়হান হাসান এলো, অনুশীলনে ভালো করল। কোচ ওকে পছন্দ করলেন। তপু বর্মন ও আতিকুর রহমান ফাহাদ চোটে পড়ল। রিয়াদুল ইসলাম রাফি ও সোহেল রানা এলো। ভালো খেলল। দলের মধ্যে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলছে।
ভারতের বিপক্ষে ওদের মাঠে অমন নৈপুণ্যের জন্য কতটা গর্বিত?
জামাল: আমি আসলে ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম কারণ মনে হচ্ছিল হেরেছি কারণ আসলে তো আমাদের সুযোগ ছিল আরও গোল ক্রয়ার। কিন্তু হ্যা দল হিসেবে গর্ব করার মতই ব্যাপার ছিল।
ভারতের কোন ক্লাব থেকে কি অফার পেয়েছেন?
জামাল: ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দল মিনার্ভা পাঞ্জাবের দুজন লোক আমাকে জিজ্ঞেস করেছেম আমার ক্লাবের অবস্থা, আমার চুক্তি কি ইত্যাদ। একজন বলছিল সুনিল ছেত্রী এত বাজে খেলেছে কেবল আমার কারণে। ওর অভিমতের জন্য ধন্যবাদ দিয়েছি।
বিশ্বকাপ বাছাইর বাকি ম্যাচ নিয়ে কি চিন্তা। বিশেষ করে ওমানের বিপক্ষে খেলা আবার কাতারে গিয়ে খেলা?
জামাল: আমার মনে হয় কাতার ও ওমান খুব শক্ত দল। পরের ম্যাচ আমাদের জন্য খুব কঠিন। কিন্তু আমাদের এখনো ভারত ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোম ম্যাচ আছে। কাজেই আমার মনে হয় আমাদের কিছু পয়েন্ট পাওয়ার আছে।
স্প্যানিশ লা লিগায় ধারাভাষ্যের অভিজ্ঞতা কেমন?
জামাল: বেশ ভালো। আগামী মাসে বার্সেলোনা যাচ্ছি একই কাজে। তারা আমাকে টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছে।
বাবা-মা এখন নিশ্চয়ই গর্বিত
জামাল: আমার আশা তাই (গর্বিত)। তারা বেশি কিছু বলে না। এবং বাড়িতে ফুটবল নিয়ে বেশি কথা হয় না।
আপনি কি প্রায়ই ডেনমার্ক যান?
জামাল: যখন ছুটি পাই তখনই ছুটে যাই, কারণ এখানে তো আমি একা থাকি।
Comments