বুয়েট নিজেদের ব্যর্থতার দায় ছাত্ররাজনীতির উপর চাপিয়েছে

আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, ‘মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার’ মতো। বুয়েট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির সোনালি ইতিহাস ভুলে, আপাত সমস্যা সমাধানের পথেই হেঁটেছে। নিজেদের ব্যর্থতার দায় ছাত্ররাজনীতির উপর চাপিয়েছে।
justice_for_abrar_fahad-1.jpg
১০ অক্টোবর ২০১৯, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার বিচার ও ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, ‘মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার’ মতো। বুয়েট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির সোনালি ইতিহাস ভুলে, আপাত সমস্যা সমাধানের পথেই হেঁটেছে। নিজেদের ব্যর্থতার দায় ছাত্ররাজনীতির উপর চাপিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ দিয়ে চলে; তারা তাদের অধ্যাদেশ অনুযায়ী এবং বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রতিটি তাদের নিজস্ব আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে সাংগঠনিক রাজনীতি চলবে, না বন্ধ হবে- তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।

সেক্ষেত্রে বুয়েটের সিদ্ধান্ত আইনসিদ্ধ এবং এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার আইনগত ভিত্তি নেই। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বুয়েট প্রশাসনকে তাদের রাজনীতি বন্ধের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করা জরুরি ছিলো।

২০০২ সালের ৮ জুন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে মারা যায় দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। এরপর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাসে। সেই সিদ্ধান্ত কি প্রত্যাহার করেছে বুয়েট?

জানা মতে করেনি। তবে কীভাবে ছাত্ররাজনীতি আবার শুরু হলো ২০০৯ সাল থেকে। এতোদিন ছাত্ররাজনীতি চলতে দেওয়াটা বুয়েট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা নয় কি? এর দায় কি প্রশাসন এড়াতে পারে?

১৯৬২ সালের বুয়েট অধ্যাদেশের ১৬ নং ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ, হল ছাত্রসংসদ ছাড়া ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের লিখিত অনুমোদন না নিয়ে কোনো ধরনের ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তাহলে বুয়েটে কি অনুমতি দিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে?

ছাত্রসংসদ বা হল ছাত্রসংসদের নির্বাচন ২০০১ সালের পর আর হয়নি। তাহলে ছাত্রদের পক্ষে কথা বলার জন্য আদৌ কি কোনো ব্যবস্থা ছিলো? এতোদিন ছাত্রসংসদের নির্বাচন না হওয়াটা কি বুয়েট প্রশাসনের ব্যর্থতা নয়? ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ কি নিজেদের ব্যর্থতাটাকেই চাপা দিতে চাইছে? পাশাপাশি এই সিদ্ধান্ত কোনো একটা ছাত্রসংগঠনের অপকর্মের দায় ছাত্রদের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে কথা বলা অনেক ছাত্রসংগঠনের উপরও চাপিয়া দেওয়া হলো।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে; ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা পর্যালোচনা করা উচিত ছিলো বুয়েট কর্তৃপক্ষের।

ছাত্ররাজনীতির অনুপস্থিতে হিযবুত তাহরির বা ছাত্রশিবির নানা ব্যানারে কার্যক্রম চালাতে পারে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।

আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে ছাত্ররাজনীতি নেই সেখানে ছাত্রদের মৌলবাদে জড়িয়ে যাওয়ার খবর এসেছে হোলি আর্টিজানের হামলার পর। এ ধরনের সংগঠনগুলো যাতে তাদের কার্যক্রম চালাতে না পারে বা ছাত্ররা মৌলবাদে আকৃষ্ট হয়ে না পড়ে তার জন্য বুয়েট প্রশাসনের প্রস্তুতি কি যথেষ্ট?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবার অনেকে বুয়েটের রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগতও জানিয়েছেন। তাদের যুক্তিও মানছি, এরশাদ পতনের পর থেকে ছাত্ররাজনীতি গতিপ্রকৃতি যে কাউকে হতাশ করতেই পারে। তবে তাদেরকেও মনে রাখতে হবে ছাত্ররাজনীতি থেকে আমরা একজন বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি। আজকের প্রধানমন্ত্রীও ছাত্ররাজনীতি করে উঠে এসেছেন। তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কিংবা হাসানুল হক ইনুও ছাত্ররাজনীতির ফসল। যদিও এদের অনেকের নামে সমালোচনাও আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবদানও অস্বীকার করা যাবে না নিশ্চয়ই।

গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো বহুমত প্রকাশ। বুয়েটের সিদ্ধান্ত কি সেই বহুমত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে যায় না? কিংবা এটি কি বিরাজনীতিকরণের একটি অংশ নয়? বুয়েটের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের সর্বোচ্চ একটা বিদ্যাপীঠে মেধাবী ছাত্রদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হলো।

আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন একসঙ্গে ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনীতি করতো এবং সেখান থেকেই উঠে আসতো পরবর্তীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তারাই পরবর্তীতে এমপি, মন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রী হতেন, দেশ পরিচালনা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিলো ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ তৈরির প্রজননভূমি।

কিন্তু, গত কয়েকটা সংসদের দিকে তাকালেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়া বা ছাত্ররাজনীতির দীনতা বুঝতে পারি। সংসদে রাজনীতিবিদের সমান হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক অতীত বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার চাইতে অর্থের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠিতে।

রাজনীতিবিদরাও এই অবস্থার দায় এড়াতে পারেন না। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোই শুধু ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার অধিকার রাখে- এমন একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে এরশাদ পতনের পর ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলোর আমলে। অথচ পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে না। বুয়েটে কোনো এক সময়ে কর্তৃপক্ষের সামনেই আবার ছাত্ররাজনীতি শুরু হবে, আবার আবরারের বা সনির মতো কেউ মারা যাবেন, কোনো মায়ের বুক খালি হবে, আবার আন্দোলন হবে এবং বুয়েট কর্তৃপক্ষ ফের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করবে। এভাবেই চলতে থাকবে যতোদিন আমরা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চর্চা না করবো, যতোদিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে না আসবো।

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য, প্রধান প্রতিবেদক, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka stares down the barrel of water

Once widely abundant, the freshwater for Dhaka-dwellers continues to deplete at a dramatic rate and threatens to disappear far below the ground.

55m ago