‘শিয়ালের মতো একশো বছর জীবন ধারণ করার চেয়ে সিংহের মতো একদিন বাঁচাও ভালো’

Tipu Sultan
টিপু সুলতান। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) জনপ্রিয় একটি ধারাবাহিক ছিলো ‘দ্য সোর্ড অফ টিপু সুলতান’। তখনো আকাশ-সংস্কৃতি এতোটা জাঁকিয়ে বসেনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বিটিভিতে তখন বিদেশি ধারাবাহিকের ডাবিং সম্প্রচার করা হতো। টিপু সুলতান ধারাবাহিকটি ছিলো তুমুল জনপ্রিয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার তেজস্বী আর ক্ষিপ্র লড়াই জয় করে নিয়েছিলো ভারত-বাংলাদেশের দর্শকদের। তিনি যে সত্যিকারের বীর ছিলেন এবং ব্রিটিশদের কাছে ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক, তা ইতিহাস ঘাঁটলেই পাওয়া যায়।

১৭৯৯ সালের ৪ মে যখন টিপু সুলতানের হত্যার খবর প্রচারিত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রশাসক রিচার্ড ওয়েলেসলি বলেছিলেন, “ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, ভারতবর্ষের মৃত আত্মাকে স্মরণ করে আমি পান করছি। গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের।”

টিপু-গবেষক ভগবান এস গিদোয়ানী তার ‘দ্য সোর্ড অফ টিপু সুলতান’ বইয়ে এমনটিই লিখেছেন। টিপু যখন ব্রিটিশদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ঠিক সে সময় ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়নের জয়জয়কার চলছিলো ইউরোপ জুড়ে। ব্রিটিশদের ভয় ছিলো টিপু হয়তো নেপোলিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত স্বাধীন করবেন। তাদের কাছে খবর ছিলো যে, তুরস্কের ওসমানীয় (অটোমান) খেলাফত এবং ফরাসি সাম্রাজ্যের প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন টিপু সুলতান।

টিপু বহুদিন ছিলেন আলোচনার বাইরে। কিন্তু, ভারতীয় টিভি চ্যানেল ডিডি ন্যাশনালে ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ শিরোনামের ধারাবাহিকটি প্রচারের ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে টিপু সুলতান হয়ে উঠে শৌর্য আর দেশপ্রেমিক এক যোদ্ধার নাম।

১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর টিপুর জন্ম। টিপু শব্দের অর্থ বাঘ। তার পুরো নাম সুলতান ফতেহ আলি খান সাহাব। পিতা হায়দার আলি ছিলেন প্রথমে মহীশূর রাজ্যের সেনাপ্রধান, পরবর্তীকালে মহীশূরের রাজা। টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর বলে। উপাধিটি ইংরেজদেরই দেওয়া। বাঘ (শের) হয়ে ওঠার পিছনে মূল কারণ ছিলো তার অসাধারণ ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা।

টিপু প্রায়ই বলতেন “শিয়ালের মতো একশো বছর জীবন ধারণ করার চেয়ে সিংহের মতো একদিন বাঁচাও ভালো।” তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় শাসক যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশরা ভারতের জন্য কতোটা বিপদজনক হয়ে উঠছে। ব্রিটিশদের উৎখাতের জন্য তিনি লড়েছিলেন চার-চারটি যুদ্ধ।

টিপুর এক সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান৷ যার ফলশ্রুতিতে টিপু সুলতান যুদ্ধে নিহত হন। মৃত্যুর পর তার পরিবারের মানুষজনকে ভেলোরের দুর্গে বন্দি করে রাখে ব্রিটিশ শাসকরা৷ পরবর্তীতে টিপুর ১২ ছেলে এবং তাদের পরিবারের সবাইকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। সেই থেকে কলকাতাতেই টিপুর পরিবারের বসবাস।

লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা টিপু সুলতানকে ভগবান এস গিদোয়ানী তার বইয়ের মাধ্যমে প্রথমে আবার জনসম্মুখে নিয়ে আসেন। এরপর, ভারতীয় পরিচালক সঞ্জয় খান টিভি সিরিয়াল বানান এবং তিনি নিজেই এই সিরিজের নাম–ভূমিকায় অভিনয় করেন।

১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই ধারাবাহিকটির শুটিংয়ে আগুন লেগে ৬২ জন কলাকুশলী মারা যান। গুরুতর আহত হয়ে প্রায় এক বছর হাসপাতালে ছিলেন সঞ্জয় খান নিজেও। সেসময় তার প্রায় ৭২টি সার্জারি লেগেছিলো। সম্প্রতি, বিজেপি সরকার দিল্লির ক্ষমতায় আসার পর টিপু সুলতানকে ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।

টিপু সুলতান না কী ছিলেন হিন্দু-বিদ্বেষী। অথচ, ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখা যায়, তিনি অনেকগুলো মন্দির স্থাপন করেছিলেন। রাজনীতি হতেই পারে টিপু সুলতানকে নিয়ে। কিন্তু, আমাদের মতো যারা ‘টিপু সুলতান’ ধারাবাহিক দেখে বড় হয়েছেন তাদের কাছে তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। আজ সেই মহানায়কের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন শের-ই-মহীশূর।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago