সরকার আইন করেছে, সরকারের লোকজনই আবার ধর্মঘট করছে!

‘আমাদের সেন্স অব অ্যাকাউন্টিবিলিটি নষ্ট হয়ে গেছে’

আইন করেছেন যারা এবং আইনের বিরোধিতা করছেন যারা তারা উভয়ই সরকারি দলের। সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান, ক্ষমতাসীন জোট সরকারের মন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা সবাই সরকারি দলের সঙ্গে রয়েছেন। আমি মনে করি, এক ধরনের গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছে।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ (বামে) এবং মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। ছবি: সংগৃহীত

সড়ক পরিবহন আইন করেছে সরকার। সরকারের মন্ত্রীরা এই আইন পাশ করেছে। সেই মন্ত্রী-এমপিদের কয়েকজন আবার  সেই আইনের বিরোধিতা করছেন। পরিবহন শ্রমিকদের নেতা আইন পাশের সময়কার মন্ত্রী, এখনকার এমপি শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট করছেন। পরিবহন মালিকদের নেতা, বর্তমান মন্ত্রী-এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গার নেতৃত্বাধীন মালিকদের সংগঠনও ধর্মঘট করছে। ধর্মঘট করছে আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে, সরকারের বিরুদ্ধে। আবার তারা নিজেরাও সরকারের অংশ! অন্যান্য পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের সংগঠনগুলোও সরকারপন্থী। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে আজ (২০ নভেম্বর) কথা হয় বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং মানবাধিকারকর্মী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সঙ্গে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে অস্পষ্ট। আমি মনে করি, এটি জনগণকে জিম্মি করা ছাড়া আর কিছু নয়। এ কেমন কথা, যারা আইন করেছেন তারাই বিরোধিতা করছেন! আইন করেছেন যারা এবং আইনের বিরোধিতা করছেন যারা তারা উভয়ই সরকারি দলের। সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান, ক্ষমতাসীন জোট সরকারের মন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং অন্যান্য মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কমবেশি সবাই সরকারি দলের সঙ্গে রয়েছেন। আমি মনে করি, এক ধরনের গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছে।”

গোঁজামিলটি কোথায়?

“প্রথম কথা হলো, তারাই এই আইনটি করেছেন। আবার তারাই এই আইনের বিরোধিতা করছেন। এই আইনটি বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্যে কঠিন হবে। শ্রমিকরা সারাদেশে ধর্মঘট করছেন। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, এই আইনের সঠিক ব্যাখ্যা কী? আইনে যা আছে তা নিয়ে অরাজকতা করা হচ্ছে কেনো? জনগণকে জিম্মি করে রেখে শেষ পর্যন্ত শ্রমিক-মালিকদের কিছু সুবিধা আদায়ের জন্যে এমনটি করা হচ্ছে।”

আইনে কী আবার পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত পাচ্ছেন?

“যেকোনো আইনের সংশোধন আসতে পারে। কিন্তু, আইনের কোন জায়গায় সংশোধন দরকার, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে তো আলোচনা করা যায়। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, এতকিছুর পর একটি আইন করা হলো, তা আবার সংশোধন করতে হবে কেন? যারা ধর্মঘট করছেন তারা তো স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। সরকার এগুলোকে কীভাবে মোকাবেলা করবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। সরকার যদি বলে- আমরা এই আইন থেকে নড়বো না। আর শ্রমিকরা যদি বলে, আমরা এটি মানবো না। তাহলে উপায়টি কী হবে? সরকার ও মালিক-শ্রমিকদের তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।”

এই আইন নিয়ে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে কি ভীতি তৈরি হয়েছে?

“সড়ক পরিবহন আইন তো শুধু বাংলাদেশে করা হয়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রয়েছে। তারা ভীতির কথা যা বলছে তাতো কোনো যুক্তিযুক্ত কথা হলো না। খুন করলে তো শাস্তি হবেই। তাহলে, খুন না করলেই হয়। শ্রমিকরা কী চান তা স্পষ্ট করে বলতে হবে। জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে না রেখে দুই পক্ষকেই বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে।”

শ্রমিক-মালিকদের সংগঠনের নেতারা তো সরকারের অংশ। তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হলে তাদেরকেই তো কথা বলতে হবে?– “আপনি ঠিক কথাটিই বলেছেন। শ্রমিক-মালিকরা কম হোক বেশি হোক সরকারের অংশ। তাদের সংগঠনগুলো সরকারপন্থী। ধর্মঘটের কর্মসূচি দেওয়া আগে তাদের সরকারের সঙ্গে বসে বিষয়টি ফয়সালা করার সুযোগ ছিলো।”

“শাহজাহান খান বলেছেন, শ্রমিকরা ভয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন না। এটি কোনো ব্যাখ্যা হলো না। উনি শ্রমিকদের নেতা। তার কথা তার সংগঠনের লোকেরা না শুনলে তার তো সরে যাওয়া উচিত। উনি শ্রমিকদের সঙ্গে আছেন, সরকারের সঙ্গেও আছেন। উনার কথা কেউ শুনছেন না তাই তাকে পদত্যাগ করতে হবে। যেহেতু উনি পদত্যাগ করছেন না সেহেতু উনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। উনি মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই সংগঠন যখন ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে তখন উনার নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ওই সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়া।”

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “যে বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়েছে তা হলো: যখনই স্বার্থের সংঘাত তখনই কে, কার দলের তা কেউ মনে রাখেন না। কিন্তু, সেটার থেকে বড় কথা- আমাদের ‘চেইন অব কমান্ড’-এ সমস্যা হয়েছে। আসলে কে যে দায়িত্বে রয়েছেন, কার কথায় কে চলবেন, কে দায়িত্ব নিবেন এবং কার দায়বদ্ধতা কোথায় তা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আমার মনে হয়- এখন কে, কোন অবস্থান থেকে কী করছেন তা তাদের নিজেদের কাছেও স্পষ্ট নয়।”

যারা আইন করেছে,তারাই ধর্মঘট করছে...

“সেই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ সামনে চলে আসে। সরকার হয়তো আইনটি দেওয়ার জন্যেই দিয়েছে। আবার সরকারি দলের লোকজনদের দিয়েই ধর্মঘট করাচ্ছে। আবার তাদের দলের নেতারাও কিছু বলছেন না। আমি সেদিকে যেতে চাই না। আমার মনে হয়, আসলে কার দায়িত্ব কতোখানি সে বিষয়ে কেউ স্পষ্ট নন। নৈতিক দায়বোধ নিয়ে কেউ চিন্তা করছেন না। আমাদের ‘সেন্স অব অ্যাকাউন্টিবিলিটি’ নষ্ট হয়ে গেছে- সে জন্যেই এমন (বিশৃঙ্খল পরিবেশ) সৃষ্টি হচ্ছে।”

“তা না হলে একই দলের লোকজন এতোরকমের অবস্থান নিচ্ছে কেনো?- এই প্রশ্ন  আমরা  করতেই পারি।”

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago