‘সরকার যখন অন্যায় করছে, তখন ন্যায়ের কথা বলা বিপদজনক’

সারা পৃথিবী জুড়েই মিডিয়ার উপর এক ধরনের খড়গ চলছে। সেটি চলছে নানান দিক থেকে। সরকার থেকে শুরু করে মিডিয়া-মালিকের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে মিডিয়া ‘ল্যাপডগ’ হয়ে গেছে। তাই বিকল্প-মিডিয়াগুলো জায়গা দখল করে নিচ্ছে ট্র্যাডিশনাল-মিডিয়া। মত প্রকাশের প্রচলিত পথগুলো যখন রুদ্ধ বা সংকুচিত তখনই মনে পড়ে ফ্রাঙ্কো ম্যারিক এ্যারোয়েট ভলতেয়ার। তবে তিনি ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত।
Voltaire
ফ্রাঙ্কো ম্যারিক এ্যারোয়েট ভলতেয়ার (২১ নভেম্বর ১৬৯৪ – ৩০ মে ১৭৭৮)

সারা পৃথিবী জুড়েই মিডিয়ার উপর এক ধরনের খড়গ চলছে। সেটি চলছে নানান দিক থেকে। সরকার থেকে শুরু করে মিডিয়া-মালিকের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে মিডিয়া ‘ল্যাপডগ’ হয়ে গেছে। তাই বিকল্প-মিডিয়াগুলো জায়গা দখল করে নিচ্ছে ট্র্যাডিশনাল-মিডিয়ার। মত প্রকাশের প্রচলিত পথগুলো যখন রুদ্ধ বা সংকুচিত তখনই মনে পড়ে ফ্রাঙ্কো ম্যারিক এ্যারোয়েট ভলতেয়ার। তবে তিনি ভলতেয়ার নামেই বেশি পরিচিত।

১৬৯৪ সালের আজকের দিনে (২১ নভেম্বর) ভলতেয়ার প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক তিনি। তার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি কবি ও নাট্যকার।

তবে ভলতেয়ারের যে উক্তি আজকের এই ঘুনে ধরা পঁচা-গলা সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক তা হলো, “তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাবো।”

তার এই বক্তব্যই প্রমাণ করে মত প্রকাশের ব্যাপারে কতোটা বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন চিন্তাই পারে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা করতে। তবে কথা থেকে যায়। ভলতেয়ার ছিলেন কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত যার কারণে তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দুর্বলতার সমালোচনা করেছেন। বরং একটি সচেতন, দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন তিনি। তার মতে, জনগণকে শিক্ষিত করলে কেবল জনগণেরই উপকার হবে তা নয়, রাজার জন্যও এটা প্রয়োজন।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে তিনি নাগরিক স্বাধীনতা, বিশেষ করে, ধর্মের স্বাধীনতা নিয়ে ছিলেন সোচ্চার। গির্জাকে তিনি ফ্রান্সের সার্বিক বিকাশে বাধা হিসেবে দেখতেন। ব্যঙ্গ-কবিতা রচনার মাধ্যমেই ভলতেয়ার সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। খ্রিস্টান গির্জা ও তৎকালীন ফরাসি সামাজিক আচার ছিলো তার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের লক্ষ্য। তিনি তার রচনার মধ্যে দিয়ে গির্জার ভণ্ডামি, মুর্খতাকে জনসম্মুখে তুলে ধরেছিলেন। তিনি মানুষের অজ্ঞতা, মূর্খতা, প্রতারণা, অন্যায়-অবিচার ও উৎপীড়নকারীকে ঘৃণা করতেন। এছাড়া তিনি মোটামুটি সব ধর্মের সমালোচনা করেছেন।

তবে তাকে নাস্তিক বলা যাবে না। কেননা, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলত তিনি ছিলেন একজন একেশ্বরবাদী। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে অন্ধ-বিশ্বাসের পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক বিচারের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ‘Treatise on Toleration’ (১৭৬৩) গ্রন্থে তিনি সব মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, সব মানুষেরই ঈশ্বর একজন। সুতরাং ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্য বিভেদ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা উচিত নয়। তার বক্তব্য ছিলো “অজ্ঞতা যতো বেশি সেখানে অসহিষ্ণুতা এবং নিষ্ঠুরতা ততো বেশি।”

এসব লেখার কারণে তাকে রাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে হয়। কারাবরণ করতে হয়। এমনকী, অবরোধের কবলেও পড়তে হয় তাকে। ১৭১৫ সালে এক অভিজাতকে বিদ্রূপ করায় তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৭১৭ সালে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরলে কবিতা লেখার জন্য তাকে বাস্তিলে এক বছরের কারাবাস করতে হয়। তবে কারাগারে থাকার সময় ‘হেনরিয়ের্ডে’ নামে একটা মহাকাব্য রচনা করেন তিনি।

তারপর ভলতেয়ার একের পর এক সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেন। তার ৮৪ বছরের জীবনে দুই হাজার গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং ২০ হাজার চিঠি লিখেছেন- যেগুলোর সাহিত্যমূল্য বিশাল। সাহিত্যিক ও সমালোচকেরা ভলতেয়ারের লেখনিকে চারভাগে ভাগ করেন- কবিতা, নাটক, ঐতিহাসিক কাজ এবং দার্শনিক লেখা।

অসামান্য প্রতিভাবান ভলতেয়ার তার অসাধারণ লেখনি শক্তি দিয়ে পুরো সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ঝড় তুলেছিলেন, মূল নাড়িয়ে দিয়েছিলেন, চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিলেন। যার ফলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে। এমনকী, নির্বাসনেও যেতে হয়েছে। তবুও তিনি পিছপা হননি। তার বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। তার লেখনি সাধারণ মানুষকে এতোটাই প্রভাবিত করতো যে, কখনো কখনো শহরের পর শহরে লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতো এবং তার রচিত গ্রন্থগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিতো।

তিনি ছিলেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সেনাপতি। যার পুরো জীবনটাই ছিলো বিতর্ক, বঞ্চনা আর নির্যাতনে ভরা। কিন্তু, এতো কিছুর পরেও ইতিহাসের মাপকাঠিতে তিনিই আজ অন্যতম লেখক এবং দার্শনিক।

আজ সেই মহামানবের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন ভলতেয়ার। লেখা শুরু করেছিলাম মত-প্রকাশের স্বাধীনতার কথা দিয়ে তাই শেষও করতে চাই বাক-স্বাধীনতার কথা দিয়ে এবং ভলতেয়ারকে উদ্ধৃত করে।

রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে তার অন্যতম একটা উক্তি হলো- “সরকার যখন অন্যায় করছে, তখন ন্যায়ের কথা বলা বিপদজনক।”

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Loss and damage is a far more complicated concept than it sounds. It has far-reaching impacts, some of which are often overlooked.

Can we finally put the Loss and Damage Fund to use?

Although the proposal for the Loss and Damage Fund was adopted at COP27, the declaration to operationalise it came at COP28.

4h ago