সংগীতের ট্র্যাজিক কুইন

বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার আরেক কৃতি সন্তান গীতা দত্তের জন্মের মাত্র আট বছর পরেই মারা যান। যদি গীতা দত্তের জীবনটা শরৎচন্দ্র দেখে যেতে পারতেন, তবে তাকে নিয়েই বোধহয় বাংলা সাহিত্যের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস লেখা হতো। কারণ গীতা দত্তের পুরো জীবনটাই সাহিত্যের এক অনন্য ছোট গল্প।
geeta-dutt.jpg
গীতা দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলার আরেক কৃতি সন্তান গীতা দত্তের জন্মের মাত্র আট বছর পরেই মারা যান। যদি গীতা দত্তের জীবনটা শরৎচন্দ্র দেখে যেতে পারতেন, তবে তাকে নিয়েই বোধহয় বাংলা সাহিত্যের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস লেখা হতো। কারণ গীতা দত্তের পুরো জীবনটাই সাহিত্যের এক অনন্য ছোট গল্প।

যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন- কী হওয়ার ছিলো, কী হতে পারতেন কিংবা কী হলেন? তার জীবনের দিকে গভীর মনোযোগ সহকারে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায়- জীবনের উত্থান পতন। পুরো জীবন যেনো একটি গোলক ধাঁধা। সংগীত বা চলচ্চিত্র জগতের এক ট্র্যাজেডি কুইন হয়েই বেঁচে আছেন ইতিহাসের পাতায়।

১৯৩০ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে এক জমিদার পরিবারে জন্ম গীতার। জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায় চৌধুরীর দশ সন্তানের পঞ্চম ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিটেমাটি ছেড়ে প্রথমে কলকাতা, তারপর সেখান থেকে বম্বে। গেলো জমিদারী আর ঠাঁই হলো বম্বের ঘিঞ্জি এলাকায়। অবস্থা এতোটাই খারাপ হলো যে, বারো বছর বয়স থেকেই গানের টিউশনি করতে হতো। বাসের পয়সা বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। যে বাড়িতে গান শেখাতেন, গরিব বলে তাকে মাটিতে বসতে বলা হতো। এই জীবনই গীতাকে মহাসংগীত শিখিয়েছিলো।

GEETA-Family.jpg
স্বামী গুরু দত্ত ও ছেলে অরুণকে গান শোনাচ্ছেন গীতা দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের থেকে কিছুটা ছোট। তবে লতার সঙ্গে একটা মিল আছে। গীতার যখন মাত্র ১২ বছর বয়স, তখন একদিন বাড়ির বারান্দায় গুনগুন করে গান গাইছিলেন, আর তা শুনেই বম্বের সুরকার হনুমান প্রসাদের নজরে এসেছিলেন এবং তাকে দিয়ে সিনেমার প্লেব্যাক করানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন।

অবশেষে ১৯৪৬ সালে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। গীতা ভক্ত প্রহ্লাদ নামের একটি চলচ্চিত্রে গান করেন। তবে সেটা কোরাসে, তাও মাত্র দুলাইন।

তবে গীতা তার সংগীতের নতুন পথের খোঁজ পান যখন বাংলাদেশের আরেক বিখ্যাত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ তাকে পরের বছরই দো ভাই ছবিতে প্লেব্যাক করান। এই এক চলচ্চিত্রে নয়টা গান দিলেন গীতা দত্তকে। গীতার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললেন, “বম্বেতে বাঙালিদের খুব নাম। মান রেখো মা।”

দো ভাই ছবি তাকে খ্যাতি এনে দেয়। লতা তখনও এতোটা জনপ্রিয়তা পায়নি। গীতা ছিলো ভাগ্যবান, কারণ লতার আগেই গীতার জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে।

সংগীতের বোদ্ধা মহলের লোকজন আজও বলেন যে, “লতাকণ্ঠী আশাকণ্ঠী হওয়া যায়, কিন্তু গীতাকণ্ঠী হওয়া যায় না।” তার কারণ, তার স্বরযন্ত্রটা আসলে ঈশ্বরের নিজের তৈরি মোহনবাঁশি। তার সঙ্গে ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তাই তার সুরে রোমান্স, উৎসব, যন্ত্রণা, ছলনা- সব অমন তীব্র ভাবে বেজে উঠতো। আর তার সেই ইমোশনটাই পরবর্তীতে তার জীবনে অন্ধকার নিয়ে এসেছিলো।

যাই হোক গীতার কণ্ঠে আসতে লাগলো একের পর এক সুপার ডুপার হিট গান। বাজি, দেবদাস এবং পেয়াসা ছবির গান আজও মুগ্ধতা ছড়ায়।

শুরুটা হিন্দি গান দিয়ে করলেও ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরে কিছু গান গেয়েছিলেন, যা মুখে মুখে ফেরে আজও।

geeta-lata.jpg
লতা মঙ্গেশকর, মীনা কাপুর ও গীতা দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

শিল্পী হিসেবে যখন তিনি বলিউড মাতাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ই তিনি বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা গুরু দত্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গীতা ও গুরু দত্তের যখন বিয়ে হয়, তখন তাদের বয়স যথাক্রমে একুশ আর সাতাশ।

ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে গুরু দত্তের ছোট বোন, চিত্রশিল্পী ললিতা লাজমি এক স্মৃতিচারণায় বলেন, “গীতাদিদি তখন আঠেরো। বিরাট স্টার। নানা ভাষায় প্রায় ন’শোটা গান গেয়ে ফেলেছেন। গলা তো মধুতে ডোবানো। নিখুঁত নাকমুখ। হরিণের মতো চোখ। আমার মা বাসন্তী পাড়ুকোন সে দিনই ওঁকে বাড়িতে আসতে বললেন। ওই গানটা যেনো ভাইয়েরই ভাগ্যটা বদলে দিলো।”

‘‘গীতাদিদি লিমুজিনে চেপে আমাদের বাড়ি আসতো। এসেই কোমরে শাড়ি গুঁজে রান্নাঘরে ঢুকে পড়তো। আনাজ কাটছে, গান শোনাচ্ছে। চিরকাল এমন ভার্সেটাইল। অগাধ ক্ষমতার অধিকারী। ওর কূল পাওয়া যায় না”, বলেন ললিতা লাজমি।

ওইদিকে গীতা দত্তের ছোট ভাই মিলন রায় তার স্মৃতিচারণায় বলেন, “১৯৫৩-য় ওই বিয়ে ছিলো ‘বিগেস্ট ওয়েডিং এভার’। দু’মাইল গাড়ির লাইন। বৈজয়ন্তী মালা, নূতন, রফি, লতা, পি সি সরকার, গীতা বালি... কে আসেননি!’’

বিয়ের কিছু দিন পরেই গুরু দত্ত নিজের হোম প্রোডাকশন ছাড়া গীতার অন্যত্র গাওয়া নিষিদ্ধ করলেন। গীতা প্রথমে মেনে নিলেও পরবর্তীতে মেনে নিতে পারেননি।

গীতার ভাই মিলন রায় বলেছেন, “তিন-চার ঘণ্টা রেওয়াজ করতো রাঙাদি। গলা বাঁচিয়ে চলতো। টক, আইসক্রিম খেতো না। বরাবরই আশ্চর্য সব ক্ষমতা ছিলো। বিদ্যুতের গতিতে গান তুলতে পারতো। দিনে ছ’টা গানও রেকর্ডিং করেছে। হয়তো ছ’টা গানই স্বতন্ত্র। রাঙাদির কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। কথাশিল্পীর সঙ্গে শব্দ নিয়ে কিছুক্ষণ বসতো। তার পর বার কয়েক রিহার্সাল করেই টেক! এর পরেই হয়তো আমাকে স্কুল থেকে তুলে নিয়ে প্রিমিয়ারে ছুটলো। কী ভীষণ ‘লাইফ’ ছিলো ওর মধ্যে।”

লতা না গীতা কে বেশি জনপ্রিয় সে আলোচনা ছিলো বলিউড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। গুরু দত্তের শর্ত, সংসার ও সন্তানের অগ্রাধিকার থাকার পরেও গীতা তার সংগীত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু গীতা-গুরুর সম্পর্কে ফাটল ধরে, যখন গুরু দত্তের সঙ্গে ওয়াহিদা রেহমানের পরিচয় ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। তাদের অন স্ক্রিন বা অফ স্ক্রিন রোমান্স তখন মোটামুটি সবার জানা। গীতা সরে আসেন গুরু দত্তের কাছ থেকে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছেদ না হলেও, তারা আলাদা থাকতে শুরু করেন। গীতা রিহার্সালে অনিয়মিত হয়ে পড়লেন। আর আশা তখন গীতার জায়গা দখল করতে লাগলো। এদিকে গীতা-গুরু দুজনই তখন আলাদা থাকছেন আর দুজনেই তখন প্রচণ্ডভাবে মদে আসক্ত।

Geeta-SD-Burman.jpg
শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে গীতা দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে সাফল্য পাওয়ার পরে ওয়াহিদা রেহমান দুরে সরে যেতে থাকেন। গুরু দত্ত ভেঙ্গে পড়তে থাকেন। ১৯৬৪ সালের ৯ অক্টোবর রাতে দু’বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে বার বার দেখতে চাইছিলেন গুরু। গীতা কিছুতে পাঠাবেন না। পর দিন সকালে, তিনবারের বার, গুরু দত্তের আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হয়। চিরঘুমে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে।

ওইদিকে সেদিন সকালেই গীতা বারবার ফোন করেছিলেন গুরু দত্তকে, যদিও গীতা তখনও জানতেন না গুরু দত্ত মারা গেছেন। যখন শুনলেন তখন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। প্রায় এক বছর নিজের তিন সন্তানকে চিনতে পারতেন না তিনি।

মানুষিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সংকটও দেখা দেয়। এ সময়ে তিনি আবার তার সংগীতের নতুন অধ্যায় শুরু করার কথা ভাবেন। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। অর্থের অনটনে সে সময়ে গীতা প্রচুর অনুষ্ঠান করেছেন কলকাতায়। কিছু ষ্টেজ শো এবং পূজার গান তার থেকে আমরা পেয়েছিলাম এই সময়ে। ১৯৬৭ সালে ‘বধূ বরণ’ ছবিতে মুখ্য ভূমিকা ছিলো তার। ‘অনুভব’ ছবিতে তার সংগীত দর্শকদের মুগ্ধ করে। এটি ছিলো তার শেষ কাজ।

১৯৭২ সালের ২০ জুলাই গলা দিয়ে সুরের বদলে বের হয়ে আসতে লাগলো রক্ত। লিভার সিরোসিসে ভোগে মাত্র ৪১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আর রেখে গেলেন আমাদের জন্য বিখ্যাত সব গান।

আন মিলো আন মিলো, বাবুজি ধীরে চলো না, তুমি যে আমার, এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে-সহ অসংখ্য গান গেয়েছেন তিনি। হারানো সুর ছবির শিল্পী চোখের আড়াল হলেও শিল্পী হিসেবে হারিয়ে যাননি বরং দিন দিন যেনো শ্রোতা হৃদয়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন। আজ শিল্পীর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন গীতা।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago