‘তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না’

robi ghosh
অভিনেতা রবি ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

জন্মটাই যেনো অভিনয়ের জন্য। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল। মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে।

কিন্তু, বাবা জীতেন্দ্রনাথ তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্না রানীকে বলতেন, “অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিলো দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতন চেহারা।”

অভিনয়ের এমনই পোকা ছিলেন যে বাড়ি থেকে তাকে বের পর্যন্ত করে দেওয়া হয়েছিলো। তবে মার সমর্থন ছিলো পুরোপুরি। তাই তিনি সামনে এগুতে পেরেছিলেন। ভাগ্যিস মার সমর্থন ছিলো নইলে বাংলা চলচ্চিত্র এতো শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা পেতো না। যিনি অভিনেতা নয়, কমেডিয়ান নয় বরং চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে সব সময় পরিচয় দিতেন। বলতেন যেকোনো চরিত্রই ফুটিয়ে তোলা একজন চরিত্রাভিনেতার কাজ।

নিশ্চয়ই খুব ইচ্ছে করছে জানতে কে এই চরিত্রাভিনেতা। তিনি বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বাঘা। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

এখনো বোধহয় চিনতে পারেননি। কারণ এই নামে তো তিনি পরিচিত নন। তিনি তো রবি ঘোষ নামে পরিচিত। ১৯৩১ সালের এই দিনে (২৪ নভেম্বর) কোচবিহারে মামাবাড়িতে জন্ম হয় রবি ঘোষের। রবি ঘোষের পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন বাংলাদেশের বরিশালের।

রবি ঘোষের বাবা জীতেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় ছিলেন রবি। বড় দিদি সবিতা এবং ছোট দীনেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও তপতী।

রবির পড়াশোনার শুরু কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে। পরে ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে তার সহপাঠী ছিলেন উত্তম কুমারের ভাই অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং এই কলেজেরই নৈশ বিভাগে বি কম-এ ভর্তি হন। নিয়মিত শরীরচর্চার শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই। কারণ তিনি হতে চেয়েছিলেন বডি বিল্ডার।

১৯৫৩ সালে কলকাতা পুলিশ-কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সেসব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। অভিনয়জীবন শুরু পঞ্চাশের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে। এর পরিচালক ছিলেন উৎপল দত্ত। নাটকে রবি ঘোষের চরিত্র ছিলো একজন সংবাদপত্র বিক্রেতার। মঞ্চের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিলো তার ভূমিকা। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। তিনি পরবর্তীতে তার ছবির জন্য রবি ঘোষকে বেছে নেন।

তিনি মঞ্চ নাটক ‘অঙ্গার’ দিয়ে দর্শকের মন যেমন জয় করে নেন। জয় করে নেন চলচ্চিত্র পরিচালকদের মনও।

robi ghosh
‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ চলচ্চিত্রে রবি ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ১৯৫৯ সালে তার ‘আহ্বান’ চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রবিকে যুক্ত করেন। কিন্তু, রবির জীবনের মোড় ঘুরে যায় তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’তে অভিনয়ের পর। ছবিতে এক চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন মূল চরিত্র।

১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চরিত্রে তার অভিনয় চলচ্চিত্রজগতে একটি মাইলফলক। বাঘা চরিত্রে অভিনয় করে অভিনয় শিল্পটিকেই এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি।

তারপর একে একে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিগুলিতে একের পর চুটিয়ে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা রবি ঘোষ।

চেহারায় কোনো আভিজাত্যের বা নায়কোচিত ছাপ না থাকলেও তার সময়ের সব চলচ্চিত্র পরিচালকের প্রিয়পাত্র ছিলেন রবি। উত্তম কুমার-সৌমিত্রদের যুগেও তিনি ছিলেন স্বমহিমায় অনন্য। সিনেমাজগতে নিয়ে এসেছিলেন এক অন্য হাওয়া। যে হাওয়ায় সহজেই গা ভাসানো যায়, যে হাওয়ার রেশ থাকে বহু বহু বছর। কিন্তু, তাকে ধরা বড্ড শক্ত। তিনি একাই সিনেমা হলগুলোকে হাউসফুল করে রাখতে পারতেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তমকুমার বলেছিলেন, “রবির পাশে অভিনয় করতে সব সময় ভয় লাগে। আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে।”

লোকে বলতো, ‘রবি ঘোষ মানেই একাই একশো’। পরিচালক তপন সিংহ তাই বলেছিলেন, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।”

রবি ঘোষ বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি সবচেয়ে পরিচিত তার হাস্যরসাত্মক চরিত্র রূপায়নের জন্য। তবে কমেডিয়ান বললে রাগ করতেন। বলতেন, “কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনও সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি একজন চরিত্রাভিনেতা।” চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশন তথা ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন।

ব্যক্তি রবি ঘোষ ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের। গুরুগম্ভীর মানুষ। সময় পেলেই ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়ে সময় কাটাতেন। আর পড়তেন প্রবন্ধ-নাটকের নানা বই। প্রথম জীবনে কমিউনিজমে দীক্ষিত হয়েও পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পড়তেন। সে অর্থে নিজে পূজার্চনা না করলেও, অন্যের বিশ্বাস-ভক্তিকে কখনও ছোট করেননি।

সত্যজিৎ রায় পছন্দ করতেন রবি ঘোষের অভিনয়। তিনি বলতেন, “রবির চোখ দুটোই কথা বলে।”

আজ রবি ঘোষের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন সত্যজিৎ রায়ের ‘বাঘা’।

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

9h ago