ভুয়া বিল-ভাউচার: ১৫ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ!

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানির ট্যাংক পরিষ্কার, অ্যাম্বুলেন্স মেরামত ও আপ্যায়ন বাবদসহ কয়েকটি খাত থেকে ১৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ছবি: স্টার

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানির ট্যাংক পরিষ্কার, অ্যাম্বুলেন্স মেরামত ও আপ্যায়ন বাবদসহ কয়েকটি খাত থেকে ১৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়া আরও কয়েকটি খাতের সাড়ে তিন লাখ টাকার সন্ধান মিলছে না। এসব অর্থ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রাহমানসহ কয়েকজন কর্মচারী আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র মতে, ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে জুন মাসেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে ৩ লাখ এবং আপ্যায়নের নামে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও, আশির দশকে পরিত্যক্ত থানা ডিসপেনসারির আগাছা পরিষ্কারের নামে আত্মসাৎ করেছেন লাখ টাকারও বেশি। এসব অনিয়মের ও দুর্নীতির অভিযোগ হাসপাতালটির স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রাহমানের বিরুদ্ধে।

মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আকন্দ জানান, এ ব্যাপারে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে।

এছাড়াও, সরকারের ‘মা ইলিশ রক্ষা অভিযান’র সময় গত ২৮ অক্টোবর ওই কর্মকর্তার সরকারি বাসায় ‘এক মন মা ইলিশ’ মজুদের দায়ে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এই সংবাদটি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

পরিত্যক্ত ডিসপেনসারি পরিষ্কার না করেই অর্থ উত্তোলন

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অদূরে থানা ডিসপেনসারিটি ১৯৮৫ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও ওই পরিত্যক্ত একতলা ছোট ভবনটির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ভুয়া বিল-ভাউচার দিয়ে তা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে দুইবার বিল উত্তোলন করা হয়েছে। অথচ সেখানে কোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে অর্থ আত্মসাৎ

সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুধু জুন মাসে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরের আগাছা, ড্রেন ও পানির ট্যাংক পরিষ্কারের নামে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত বিল ভাউচারের কপি ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছরের (২০১৮ সাল) নভেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে আগাছা, ড্রেন ও পানির ট্যাংক পরিষ্কার বাবদ পৃথক সাতটি বিলের মাধ্যমে মোট ৯ লাখ ৪ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯০ হাজার টাকা করে ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার বাবদ উত্তোলন করা হয়েছে। চলতি বছরে আবারও একই খাতে শুধুমাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের চারপাশ ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবনের আশপাশ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। এছাড়া প্লাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন আবর্জনায় ভরপুর রয়েছে। আবাসিক ভবনের পেছনের অংশ দেখে মনে হবে সেটি বহুদিনেও পরিষ্কার করা হয়নি।

জুন মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রাহমান কথিত কোটেশনের মাধ্যমে হাসপাতালের চারদিকের জঙ্গল পরিষ্কার, ড্রেন পরিষ্কার বাবদ ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধান করে জানা যায়, যে কোটেশনের মাধ্যমে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকার বিল-ভাউচার করে খরচ দেখানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তা শাহীন আলম নামের এক ব্যক্তিকে ঠিকাদার সাজিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিষ্কার দেখিয়ে টাকা উত্তোলন

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে শ্যামগঞ্জ হাট উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আবর্জনা পরিষ্কার বাবদ মাসে ১০ হাজার করে এক বছরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এক মাসে আপ্যায়ন বিল লাখ টাকার বেশি

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শুধু এক মাসেই (চলতি বছরের জুন) আপ্যায়ন বাবদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিল দেখানো হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ আসাদ মিয়া বলেন, “আপ্যায়ন বাবদ যে বিল করা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক এবং ভুয়া। ২৫০-শয্যাবিশিষ্ট মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালেও মাসে ১০ হাজার টাকার বেশি আপ্যায়ন বিল হয় না।”

অ্যাম্বুলেন্স মেরামত দেখিয়ে অর্থ নয়-ছয়

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুরাতন অ্যাম্বুলেন্স মেরামতের জন্য ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া, পরবর্তীতে আরও ৯৪ হাজার টাকা বিল করা হয়েছে। তবে এই টাকা কখন খরচ করা হয়েছে বিলে তা উল্লেখ নেই।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ আসাদ মিয়া এবং প্রধান সহকারী আবদুল বাতেন জানান, “শুধু ভুয়া বিল-ভাউচার করে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।”

তারা আরও জানান, হাসপাতালের আসবাব ক্রয় ও মেরামত বাবদ বিভিন্ন ভুয়া বিল করে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা, কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ বাবদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব টাকা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আশিকুর রাহমানসহ অফিস সহকারী রজ্জব আলী খান ও ফজলুল হক এবং যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সহকারী ফিরোজ তালুকদার মিলে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

পরিসংখ্যানবিদ এবং প্রধান সহকারীর মতে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে যেসব ফলজ ও বনজ গাছ কাটা হয়েছে সেগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩ লাখ টাকার বেশি হবে। অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে এসব গাছ কেটে বিক্রির চেষ্টা করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে সেসব গাছের গুঁড়ি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ফেলে রাখা হয়।

দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম রাজা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত। তিনি এটি উপজেলা সমন্বয় সভায় উত্থাপনও করেছেন। তার মন্তব্য, এধরনের অনিয়মের তদন্ত হওয়া দরকার।

এসব দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আকন্দ বলেন “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”

Comments