‘সত্যিকারের বেঁচে থাকা মানে অন্যদের মাঝে বেঁচে থাকা’

মাত্র ১২ বছর বয়স। রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন স্কুলের দিকে। হঠাৎ রাস্তার বখাটে ছেলেরা আক্রমণ করে প্রচণ্ড মার দেয় তাকে। এই একটি ঘটনাই তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। হয়ে উঠেন বিশ্বের সেরা মার্শাল আর্ট শিল্পী। কোটি তরুণের স্বপ্নের আইডল তিনি। তাকে অনুসরণ করে কোটি কোটি তরুণ হয়ে উঠে মার্শাল আর্ট শিল্পী। মাত্র ৩২ বছরের জীবনে পৃথিবীতে যে ছাপ তিনি রেখে গেছেন তা ইতিহাসে বিরল।
Bruce Lee
‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ চলচ্চিত্রে ব্রুস লি। ছবি: সংগৃহীত

মাত্র ১২ বছর বয়স। রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন স্কুলের দিকে। হঠাৎ রাস্তার বখাটে ছেলেরা আক্রমণ করে প্রচণ্ড মার দেয় তাকে। এই একটি ঘটনাই তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। হয়ে উঠেন বিশ্বের সেরা মার্শাল আর্ট শিল্পী। কোটি তরুণের স্বপ্নের আইডল তিনি। তাকে অনুসরণ করে কোটি কোটি তরুণ হয়ে উঠে মার্শাল আর্ট শিল্পী। মাত্র ৩২ বছরের জীবনে পৃথিবীতে যে ছাপ তিনি রেখে গেছেন তা ইতিহাসে বিরল।

বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী ১০০ মানুষের একটি তালিকা করেছিলো এবং সেখানে জ্বলজ্বল করছিলো তার নাম। এখনো তাকে সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী এবং বিখ্যাত মার্শাল আর্ট শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়।

নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কার কথা বলছি?

তিনি ব্রুস লি।

১৯৪০ সালের এইদিনে (২৭ নভেম্বর) তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকোর চায়না টাউনে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লি হো-চুং ছিলেন ক্যান্টনিজ অপেরা ও চলচ্চিত্র তারকা এবং মা গ্রেস হো। বাবার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে মাত্র তিনমাস বয়সে গোল্ডেন গেইটগার্ল ছবিতে ব্রুস লিকে দেখা যায়। জন্ম আমেরিকাতে হলেও বেড়ে উঠেন হংকংয়ের কাউলুনে।

কিন্তু, রাস্তায় মার খাওয়ার পরে ব্রুস সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিহত করা শিখতে হবে। ব্রুস নামের অর্থ হলো শক্তিশালী। ১৩ বছর বয়সে মাস্টার ইপ ম্যানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার এবং তিনি তাকে উইং চুন স্টাইলের মার্শাল আর্টে প্রশিক্ষণ দেন।

ব্রুস হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন ১৯৬০ সালে। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ১৮ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। ১৯৬১ সালে ভর্তি হন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে। সেসময় তিনি মার্শাল আর্ট শেখা শুরু করেন।

Bruce Lee
ব্রুস লি। ছবি: সংগৃহীত

রক্তে যেহেতু অভিনয়, তা তিনি এড়াবেন কীভাবে! তাই ১৮ বছর হওয়ার আগেই তিনি বিশটির মতো ছবিতে অভিনয় করে ফেলেন। কিন্তু, নেশা যে মার্শাল আর্ট। তাই চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মার্শাল আর্টে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। প্রযোজক উইলিয়াম ডজিয়েরের চোখে পড়েন ব্রুস। ১৯৬৬ সালে এবিসি টেলিভিশন সিরিজ ‘দ্য গ্রিন হর্নেট’ তিনি অভিনয় করেন। কিন্তু, মার্শাল আর্ট শেখানোর কাজ বন্ধ করেননি। অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি ছবির কোরিওগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেন তিনি। ততোদিনে বুঝে গিয়েছিলেন যে তার কদর আমেরিকাতে হবে না। তাই ফিরে আসেন হংকংয়ে। জীবনটিও যেনো পাল্টে যায় পুরোপুরি।

১৯৭১ সালে তিনি ‘দ্য বিগ বস’ ছবিতে প্রধান একটি চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান। এতোদিন পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেও মূল চরিত্রে অভিনয় করতে পারেননি। এই ছবিতে তিনি তার জাত চেনান। সুপার-ডুপার হিট হয় এটি। শুধু হংকং নয় সারা পৃথিবীতে নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালে ব্রুস লি অভিনয় করেন ‘ফিস্ট অফ ফিউরি’ ছবিতে। এর আগে ‘দ্য বিগ বস’ যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলো সেটিকেও ভেঙে দেয় এই ছবিটি।

আত্মবিশ্বাসী ব্রুস এবার আরেক ধাপ এগিয়ে নিজেই ছবি পরিচালনায় নামেন। একই সঙ্গে পরিচালনা, অভিনয় এবং কোরিওগ্রাফ- তিনটিতেই তিনি কাজ করেন। এমনকী, ছবির চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন তিনি। ছবির নাম ‘ওয়ে অফ দ্য ড্রাগন’। এই ছবিতে ব্রুস মার্শাল আর্ট ভিন্ন রূপে তুলে ধরেন। ফলাফল- আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে দুর্দান্ত সফল ছবি। এরপরেই মার্শাল আর্ট ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে সারাবিশ্বে। তিনি হয়ে উঠেন বিশ্বজোড়া এক আইকনিক ফিগার। চীনা জাতীয়তাবাদকে ধারণ করার কারণে চীনাদের মধ্যেও বিশেষ সমাদর লাভ করেন ব্রুস।

তারপরে শুরু করেন ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ ছবির কাজ। এই ছবিটি ছিলো চীন-মার্কিন যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত প্রথম ছবি। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। এটি তার সর্বশেষ ও সবচেয়ে সফল ছবি। কিন্তু, ছবিটি প্রিমিয়ারের কয়েকদিন আগে মারা যান ব্রুস। মৃত্যুর আগে চিত্রায়িত অ্যাকশন দৃশ্যগুলো ‘গেম অব ডেথ’ ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্রুস লির মৃত্যুকে ঘিরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা আজও শোনা যায়।

তিনি কি শুধুই অভিনেতা বা মার্শাল আর্ট শিল্পী ছিলেন? না, তিনি অসাধারণ নাচতে পারতেন। ১৯৫৮ সালে তিনি একটি নাচের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নও হন। তখন মাত্র হাইস্কুলে পড়তেন। তার এই দক্ষতা তাকে পরবর্তী জীবনে কোরিওগ্রাফার হতে উৎসাহিত করে।

ব্রুস লি বাতাসের চেয়েও বেশি গতিতে ফাইট করতে পারতেন। এতো ক্ষিপ্র গতিতে তিনি হাত চালাতেন যে প্রতিপক্ষ আঘাত প্রতিহত করারও সময় পেত না। ১৯৬২ সালে একটি ফাইটে তিনি মাত্র ১১ সেকেন্ডে তার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। এই ১১ সেকেন্ডে তিনি ১৫টি ঘুষি আর একটি কিক মেরেছিলেন তাকে। মানে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে একটির বেশি ঘুষি মেরেছিলেন ব্রুস। ভাবা যায়?

তার কিকের ক্ষিপ্ততা এতোটাই ছিলো যে, একটি ফিল্মের শুটিংয়ের সময় পায়ের গতি ৩৪ ফ্রেম ধরে করতে হতো যাতে দর্শকদের মনে না হয় তিনি নকল অভিনয় করছেন। তার সম্পর্কে আরেকটি কথা প্রচলিত ছিলো যে তিনি চালের দানাকে শূন্যে ছুড়ে দিতেন এবং চপস্টিক দিয়ে সেই দানাকে শূন্যে ভাসা অবস্থাতেই ধরে ফেলতেন।

Bruce Lee
ব্রুস লি। ছবি: সংগৃহীত

ব্রুস লি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলির ভক্ত। তার ইচ্ছা ছিলো আলির সঙ্গে ফাইট করার কিন্তু সে ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়।

ব্রুস লির আঙুলের এতো জোর ছিলো যে, তিনি সফট ড্রিঙ্কসের ক্যান ফুটো করে দিতে পারতেন। বলে রাখা দরকার, ওই ক্যান পাতলা অ্যালুমিনিয়ামের নয়, স্টিলে তৈরি।

কিন্তু ব্রুস লির এতো শারীরিক ক্ষমতা থাকলেও তিনি বলতেন “ঘুসি বা লাথি মেরে কখনো জেতা যায় না।” তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান আহরণের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। তার নিজস্ব একটি লাইব্রেরি ছিলো যেখানে প্রায় দুই হাজারের মতো বই ছিলো। তিনি বলতেন, “জ্ঞান মাত্রই নিজেকে জানা।”

কবিতাও লিখতেন তিনি, তার কবিতা রয়েছে তার লেখা ‘তাও অব জিত কুনে দু’ বা মার্শাল আর্টের কৌশল বইটিতে।

বর্তমানে বিখ্যাত অভিনেতা জ্যাকি চ্যান তার ফিল্মের ক্যারিয়ার শুরু করেন ব্রুস লির স্টান্টম্যান হিসেবে।

ব্রুস লি এক ঘণ্টা মার্শাল আর্ট শেখানোর জন্য তৎকালীন সময়ে ২৭৫ ডলার নিতেন যা বর্তমান সময়ে প্রায় দুই লাখ টাকা।

কিছু কাজ ছিলো যা ব্রুস লি একদমই করতে পারতেন না। যেমন তিনি সাঁতার কাটতে পারতেন না। কারণ, তার একুয়াফোবিয়া বা পানি ভীতি ছিলো। তাছাড়া তিনি বাইক বা গাড়ি কোনোটাই চালাতে পারতেন না।

শুধু একজন মার্শাল আর্ট শিল্পী কিংবা অভিনেতা নন, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, একজন শিক্ষক, একজন আর্টিস্ট, একজন ফিল্মমেকার। মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা গেলেও এখনো তিনি অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।

তিনি সব সময় বলতেন ‘সত্যিকারের বেঁচে থাকা মানে অন্যদের মাঝে বেঁচে থাকা’।

তার এই উক্তির প্রমাণ তো তিনি নিজেই। মৃত্যুর এতো বছর পরেও তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। শুভ জন্মদিন ব্রুস লি।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago