‘বোলিংয়ে উন্নতি হলেই ব্যাটিংয়ের মান ভালো হবে’

ebadat and mushfiq
ছবি: সম্পাদিত

ভারতের বিপক্ষে সবশেষ টেস্ট সিরিজে দলটির শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ করেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। এরপর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে দেশের ব্যাটসম্যানদের মান ও দক্ষতা নিয়ে। দুটি টেস্ট ম্যাচে তিন দিনের ভেতরে মুমিনুল হকরা ইনিংস ব্যবধানে বাজেভাবে হেরে যাওয়ায় কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে তাদের টেকনিককে। ব্যাটসম্যানরা যেন টেস্ট ক্রিকেটে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারেন সেজন্য দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকদের বিভিন্ন করণীয় নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।

উত্তরণের দ্রুত কোনো পথ কী আছে?

অবশ্যই না। তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান নেই। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটকে ঢেলে সাজানো- এই দুইয়ের সমন্বয়ে বর্তমান দুরবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।

জোর দিতে হবে শক্তিশালী বোলিং বিভাগ গড়ে তুলতে:

টেস্টে সাফল্য পেতে ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের অনেকে কেবল ব্যাটসম্যানদের মান উন্নয়নে জোর দেওয়ার কথা বলছেন। তবে অভিজ্ঞ ঘরোয়া কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, যিনি বাংলাদেশের অনেক তারকা ক্রিকেটারকে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসতে দেখেছেন, তার মতে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে দক্ষতাসম্পন্ন পেস এবং স্পিন বোলার খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে।

‘একটা দেশের ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের মান নির্ভর করে আসলে সেই দেশের বোলারদের দক্ষতার ওপর। নেটেও যখন আপনি দক্ষ বোলারের মুখোমুখি হবেন না, তখন ব্যাটিংয়ে উন্নতি হবে না। বোলিংটায় উন্নতি করতে পারলে সেটা ব্যাটিংয়ের ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ভারতীয় দলটাই তার সেরা উদাহরণ।’

‘দেশের মাটিতে আমরা আধিপত্য বিস্তার করেই খেলছি। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজির কারণে আমরা ম্যাচগুলো জিতি। আমাদের যেহেতু স্পিন আক্রমণ ভালো আছে, ওটার ওপর নির্ভর করে পিচ বানিয়ে আমরা জিতেছি। কিন্তু ফাস্ট বোলিংয়ের দুর্বলতাটা একেবারে প্রথম থেকেই ছিল। এটা আজকের ব্যাপার না। টেস্ট ক্রিকেট যখন আমরা শুরু করেছি, তখন থেকেই জোরে বল করতে পারে এমন বোলার আমাদের খুব কমই এসেছে, যারা আসলে উইকেট নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। যখন মাশরাফী (বিন মোর্ত্তোজা)-শাহাদাত (হোসেন) ছিল, তখন একটা ইউনিট ছিল। কিন্তু এরপর থেকে আসলে সেরকম বোলার নেই।’

‘স্পিনে আমাদের যে স্ট্রেংথ (শক্তি), সেটা আসলে দেশের উইকেটের জন্য, কন্ডিশনের জন্য ভালো। কিন্তু বাইরের উইকেটের জন্য তারা আসলে ভালো না। খুব বেশি অস্ত্র আমাদের বোলারদের ভাণ্ডারে নেই। কিছু নির্দিষ্ট কৌশল আমাদের আছে। খুব বেশি বোলার নেই যাদের বাড়তি কোনো অস্ত্র আছে। সাকিব (আল হাসান) হয়তো ফ্লাইট দিয়ে একটা উইকেট নিয়ে নিতে পারে। ওর সে অভিজ্ঞতাটা হয়ে গেছে। কিন্তু যেসব উইকেটে টার্ন নাই, সেখানে কী করতে হবে বাকি বোলাররা কিন্তু সেটা জানে না। বোলিংয়ের দুই বিভাগেই যদি ভালো না হই আমরা, তাহলে ফল পাওয়াটা খুবই কঠিন।’

ভারতের বিপক্ষে সিরিজে উঠে এসেছে বাস্তব চিত্র:

ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধরাশায়ী হওয়া নিয়ে একবারেই বিস্মিত হননি সালাহউদ্দিন। দুটি টেস্ট ম্যাচ তিন দিনের ভেতরে শেষ হয়ে যাওয়াতেও অবাক হননি। তার মতে, এই সিরিজে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান বেহাল অবস্থার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া গেছে, উঠে এসেছে বাস্তব চিত্র।

‘শেষ যে সিরিজ নিয়ে এত কথা হচ্ছে, সবার কাছে মনে হচ্ছে, আমাদের ব্যাটসম্যানরা কি ব্যাটিং-ই পারে না! আসলে বিষয়টা হলো যে এরকম পরিস্থিতিতে তারা অভ্যস্ত না। তারা অনেকদিন ধরে এরকম কঠিন অবস্থায় পড়েনি। আমাদের সেরা চার ব্যাটসম্যানের মধ্যে দুজনই (সাকিব-তামিম ইকবাল) নাই। তারা এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত। তাদের অভ্যাস আছে। কিন্তু দলের বাকিদের এরকম পরিস্থিতিতে পড়ার অভিজ্ঞতা নাই। যদি অভ্যস্ততা না থাকে, তাহলে ফল তো শেষ পর্যন্ত খারাপ-ই হবে। এরকম পরিস্থিতিতে যখন তারা বারবার পড়বে, তখন তারা একটা সমাধান বের করতে পারবে।’

‘১৪০ কিলোমিটার গতির বল আমাদের ক্রিকেটারদের খেলার অভিজ্ঞতা আছে। দেশের বাইরেও। কিন্তু যখন এর সঙ্গে বাউন্স আর স্যুয়িং যোগ হচ্ছে, তখন তাদের মনে হচ্ছে, এটা তো একেবারে নতুন! এটা আসলে অনুশীলনের ব্যাপার। প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। আর ভারতের বিপক্ষে এরকম একটা অনভিজ্ঞ দল নিয়ে খুব বেশি কিছু আশা করা ঠিকও না।’

‘ঘরোয়া ক্রিকেটে আমরা ১২৫ কিলোমিটার গতির স্যুয়িংয়ে পড়েছি। সেটা আমরা সামলে নিতে পাড়ি। কিন্তু জোরে বলের ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা হয়ে যায়। নতুন পরিস্থিতিতে না পড়লে তো আপনি কিছু শিখতে পারবেন না।’

টেস্ট সংস্কৃতি এবং বোর্ডের ভূমিকা, দায় ও করণীয়:

২০ বছরে পা দিলেও টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে বেমানান যেন বাংলাদেশ। সাদা পোশাকে খেলার সংস্কৃতিটা ঠিকঠাকভাবে গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বেশ কিছু ঘাটতি দেখছেন সালাহউদ্দিন, চাইছেন আলাদা টেস্ট বোলিং ইউনিট ও বিনিয়োগ।

‘আমাদের দেশে একটা বোলার দল থেকে বাদ পড়ে গেলে তার ফেরার সুযোগটা খুব কম থাকে। যারা জাতীয় দলে থাকে, তারা হয়তো ইনডোর ব্যবহার করতে পারছে, বোলিং মেশিন ব্যবহার করতে পারছে, কোচ পাচ্ছে, অনুশীলনের সুবিধা পাচ্ছে। যে বাদ পড়ে যায় তার না থাকে অনুশীলনের সুযোগ, না থাকে কোচ। একেবারেই সুযোগ নাই। যারা বাদ পড়ে যায়, তাদের ওপর আমরা কোনো নজর দেই না। যে কারণে ফেরাটা কঠিন হয়ে যায়। যারা ফেরে, তারা নিজেরা নিজেরা কাজ করে তারপর ফেরে।’

‘পেস বোলিংয়ে আমাদের আরও বেশি বিনিয়োগ করা উচিৎ। যেসব ছেলেদের দেখে মনে হবে যে তারা টেস্টে ভালো করবে, যাদের উচ্চতা আছে, বলে মুভমেন্ট আছে, ওই ধরনের বোলারদের ওপরে আরও বেশি বিনিয়োগ করা উচিৎ। আলাদা একটা পেস বোলিং ইউনিট তৈরি করে তাদের পেছনে একনাগাড়ে সময় দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে। না হলে আমাদের এভাবেই চলতে থাকবে (বাজে পারফরম্যান্স)। স্পিনের ক্ষেত্রেও একই।’

‘ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলোয়াড়রা যেন তাদের কোচদের সঙ্গে বেশি সময় পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সবশেষ জাতীয় লিগের দলগুলো প্রতিযোগিতা শুরুর আরও আগে তৈরি করা যেত। কোচদের দল বুঝিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু অল্প সময় থাকায় কোচরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারার আগেই মাঠে নেমে পড়তে হয়। ফলে কোনো খেলোয়াড়ের দুর্বল দিক নিয়ে কাজ করার তেমন সুযোগ পাওয়া যায় না। এসব বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।’

‘কীভাবে ভালো করতে হবে, পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যেতে হবে সে স্বপ্নটা ছোটবেলা থেকে খেলোয়াড়দের দেখাতে হবে, এটা জাতীয় দলে এসে সম্ভব না। এই ধরনের মোটিভেশন বয়সভিত্তিক দল থেকে খেলোয়াড়দের মধ্যে বুনে দিতে হবে। মানসিক জোরের জায়গাটা তৈরি করতে হবে। কেউ যদি জাতীয় দলে এসেও মানসিকভাবে শক্তিশালী না হয়ে থাকে, তাকে আসলে গড়ার সুযোগ থাকে না।’

নতুন ও উঠতি ক্রিকেটারদেরও রয়েছে দায়:

নতুন যেসব ক্রিকেটার দলে সুযোগ পাচ্ছেন বা যারা উদীয়মান, তাদের দক্ষতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই সালাহউদ্দিনের। তবে তাদের মধ্যে একাগ্রতা ও বড় স্বপ্ন দেখার ঘাটতি ধরা পড়েছে এই কোচের পর্যবেক্ষণে। অর্থাৎ ক্রিকেটারদেরও দায় দেখছেন তিনি।

‘আমরা এখন পর্যন্ত যতগুলো টেস্ট ম্যাচ জিতেছি, চার জন অভিজ্ঞ তারকার ওপর নির্ভর করেই (সাকিব-তামিম-মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ) জিতেছি। এদের পাশাপাশি দেশের মাটিতে (মেহেদী হাসান) মিরাজ উইকেট নিয়েছে, মুমিনুল রান করে সাহায্য করেছে। কিন্তু মূলত ওই চার জনই মূল ভূমিকা রেখেছে। তবে আমার মনে হয়, আমি হয়তো ভুলও হতে পারি, তাদের মধ্যে যে একাগ্রতা আছে, আমি তা এখনকার খেলোয়াড়দের মধ্যে সেভাবে দেখতে পাই না। তারা হয়তো বিশ্বাসও করে না যে, তারা সাকিবের চেয়ে বড় খেলোয়াড় হতে পারবে কিংবা তামিমের চেয়ে বড় ব্যাটসম্যান হতে পারবে। এরকম বিশ্বাস কারও থাকলে সেটা তার কাজের মধ্যে প্রকাশ পেত। শুধু অনুশীলন করে উন্নতি হয় না।’

‘সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা কত খারাপ সময় থেকে উঠে এসেছে। বিশ্বমানের খেলোয়াড় হতে পেরেছে। তারা যদি পারে, তবে এখনকার খেলোয়াড়রা কেন নয়? তাদের বিশ্বাসের জায়গাটাই তৈরি হয়নি। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া মানেই সবকিছু পেয়ে গেলাম, এমনটা হলে তো চলবে না। আর সাকিব-তামিমদের যদি ছয়-সাত বছর লেগে থাকে বিশ্বমানের হতে, তবে বর্তমানের খেলোয়াড়দের আরও কম সময় লাগার কথা, তিন-চার বছর। এদের পরের যারা আসবে, তাদের আরও কম সময় লাগার কথা। এটাই প্রক্রিয়া। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।’

টেস্টকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে:

সবশেষে, দেশের ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নে টেস্ট ক্রিকেটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি, ‘আপনি ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি যতই ভালো দল হন, টেস্টে ভালো করতে না পারলে পুরো দেশের ক্রিকেটের ওপর একটা খারাপ প্রভাব পড়বে। টেস্টে ভালো না করতে পারলে আসলে দেশের ক্রিকেটের মান বোঝা যাবে না। যে কারণে এই জায়গাটায় ভালো করতেই হবে। সমস্যা তো থাকবেই। উত্তরণ করাটা বেশি জরুরি।’

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh women retain SAFF glory

Bangladesh retained the title of SAFF Women's Championship with a 2-1 win against Nepal in an entertaining final at the Dasharath Stadium in Kathmandu today. 

13m ago