সরকারের আগ্রাসী ব্যাংক ঋণ: সংকটে বেসরকারি খাত
রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার বার্ষিক সীমা অতিক্রম হতে যাচ্ছে। এতে পর্যাপ্ত ঋণের অভাবে বেসরকারি খাত সংকটে পড়তে পারে।
বাজেটে নির্ধারিত সীমার ৯০ শতাংশ ঋণ (৪২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা) ২১ নভেম্বরের মধ্যেই নিয়ে ফেলেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিলো।
ডিসেম্বরে সরকার অতিরিক্ত ৪ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কারণ, সরকারি কোষাগারে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ছিলো।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সরকারের ঋণ নেওয়ার বর্তমান ধারাটি নজিরবিহীন, কারণ এ দেশের অর্থনীতি কখনও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের ব্যাপক হারে ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকের তারল্য সংকট আরও বাড়বে এবং এটি শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাতকে ঝুঁকিতে ফেলবে।”
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ব্যাংক ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষের দিকে সরকারের এই খাত থেকে নেওয়া ঋণের অংক দাঁড়াতে পারে প্রায় ১০০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে, চলতি অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার সীমা হচ্ছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।”
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রাক্তন এই কর্মকর্তা বলেন, “বেসরকারি খাত সাম্প্রতিক সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ নিয়ে কাজ করছে এবং সরকারের উচ্চহারে ঋণ নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”
বেসরকারি খাতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিলো ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যা সেপ্টেম্বর ২০১০ এর পরে সবচেয়ে কম।
তিনি এই অবস্থার জন্য রাজস্ব সংগ্রহে পর্যাপ্ত চেষ্টা না করা এবং সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের অদূরদর্শিতাকে দায়ী করেন।
চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ৬২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছে।
রাজস্ব সংগ্রহের ঘাটতি নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “রাজস্ব আয়ের ঘাটতি ইঙ্গিত দেয় যে, আমাদের অর্থনীতি এখন গতিশীল নয়। উৎপাদন খাত সাবলীলভাবে চলছে না। ফলে, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) সংগ্রহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।”
তিনি বলেন, “শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সাম্প্রতিক মাসগুলিতে উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। এর প্রভাবে রপ্তানি আয়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেটি অর্থনীতির মন্থরতার লক্ষণ।”
রাজস্ব আদায়ের মন্থর গতি সাম্প্রতিক বছরগুলির জিডিপি প্রবৃদ্ধির সরকারি হিসাবের যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করেছে বলে মনে করেন তিনি। কারণ, উচ্চ প্রবৃদ্ধি সাধারণভাবে সরকারকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বাড়াতে এবং ব্যাংক ঋণ এড়াতে সহায়তা করে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপের কারণে সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া কমেছে। ফলে, বিকল্প হিসেবে ব্যাংক থেকে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “সরকার ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ব্যাপক পরিমাণে সরকারের ঋণ নেওয়ায় চলমান তারল্য সংকট আরও ঘনীভূত হবে।”
তিনি বলেন, “সুদ হার হ্রাস করার ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ ব্যাংক ঋণ নেওয়ার বিষয়টি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।”
তিনি আরও বলেন, “বড় প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকার এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর জের ধরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আগামীতে আরও বাড়বে। ফলশ্রুতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে, যা সাধারণ মানুষকে সংকটে ফেলবে।”
বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ’ এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “চলতি বছর শেষ হতে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন নতুন ঋণ দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছে না। আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সময় পার করছে ঋণদাতারা।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর আরও বলেন, “বেশিরভাগ ব্যাংক জানুয়ারি থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেবে। তবে উচ্চ মাত্রায় সরকারি ঋণ এক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে। চলমান প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, আগামীতে সরকারের ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। বেসরকারি খাত এবং ব্যাংকগুলোর স্বার্থে এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।”
Comments