সেই অং সান সু চি গণহত্যার পক্ষে!

অং সান সু চি। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আজ (১০ ডিসেম্বর) থেকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে। হেগের এই আদালতের যেকোনো রায়ই চূড়ান্ত, পালন বাধ্যতামূলক। চূড়ান্ত রায়ের পর আপিলের কোনো সুযোগ নেই।

মামলায় মিয়ানমারের পক্ষে লড়তে হেগে পৌঁছেছেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। একদা শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নেত্রীর যেখানে এমন গণহত্যার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার কথা, সেখানে তার বিপরীত ভূমিকায় নিন্দার ঝড় উঠেছে সারা পৃথিবী জুড়ে।

১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন সু চি। শান্তিপূর্ণ পথে জাতিগত বিভেদ নিষ্পত্তির চেষ্টা করে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কার পান তিনি।

কিন্তু, সারাবিশ্বকে অবাক করে দিয়ে সু চি সরাসরি গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে, প্রথম দিকে সু চি নীরব থাকেন। তারপর বলতে শুরু করেন, ‘গণহত্যার’ ঘটনা ঘটেনি। সেই থেকে গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন মিয়ানমার নেত্রী।

সু চি ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বার্মার রেঙ্গুনে (বর্তমানে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন) জন্মগ্রহণ করেন। মিয়ানমারের মুক্তি আন্দোলনের নেতা অং সানের সন্তান তিনি। অং সান ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে গুপ্ত হত্যার স্বীকার হন।

১৯৬০ সালে সু চির মা খিন চি ভারতে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে সু চি সেখানেই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন সু চি। তিনি বর্মী, ইংরেজি, ফরাসি ও জাপানি ভাষায় কথা বলতে পারেন।

১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে ফিরে জান্তা-বিরোধী অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৯০ সালে মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সু চির দল। কিন্তু, তৎকালীন সামরিক সরকার সেই নির্বাচনের ফল বাতিল করে তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বেশির ভাগ সময় তিনি গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৯১ সালে গৃহবন্দি থাকা অবস্থাতেই তাকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হয়। সেসময় বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী তাকে সমর্থন করে।

২০১১ সালে তার বন্দিদশা নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ‘দ্য লেডি’ মুক্তি পায়। অং সান সু চি এবং তার ব্রিটিশ স্বামী মাইকেল আরিসের প্রেমের গল্প ছিলো এর মূল উপজীব্য। সু চি বন্দি থাকাকালে তাদের মধ্যকার দূরত্ব ও কষ্টের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এতে।

২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু সু চি রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারেননি। কারণ, মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী বিদেশী নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে হলে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা হারান।

এই সমস্যা সমাধান করে তাকে ‘সেনা নিয়ন্ত্রিত’ পদ দেওয়ার জন্যে ২০১৬ সালে স্টেট কাউন্সিলর পদ সৃষ্টি করে সামরিক বাহিনী। এই পদে আসীন হয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির অফিস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। যদিও অদৃশ্যভাবে সব ক্ষমতা থেকে যায় সামরিক বাহিনীর হাতেই। তখন থেকেই সূ চির গণতান্ত্রিক ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে। রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরুর পর সু চির আসল চেহারা প্রকাশিত হয়। তিনি আবির্ভূত হন সামরিক বাহিনীর ঢাল হিসেবে।

২০১৭ সালের আগস্টে একটি সামরিক অভিযানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী জাতিগতভাবে নির্মূল প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের বিতাড়িত করে।

অং সান সু চি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি মনে করি না যে এখানে জাতিগতভাবে নির্মূলের ঘটনা ঘটেছে। আমার মনে হয়, এখানে যা ঘটছে তা প্রকাশ করার জন্য ‘জাতিগতভাবে নিধন’ কথাটি ব্যবহার করা অতিরঞ্জন হবে।”

রোহিঙ্গারা বংশ পরম্পরায় মিয়ানমারে বসবাস করেও আসলেও তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে মিয়ানমার সামরিক সরকার। সারাবিশ্বের চেয়েও সু চি এই সত্য জানেন বেশি ভালো করে। কিন্তু, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চি দেশের রাজনীতিতে সুবিধা করার জন্যে সামরিক বাহিনীর করা গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক আদালতে।

মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য ২৫ ভাগ সংসদীয় আসন বরাদ্দ রয়েছে। সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাদের ভেটো দেওয়ার অধিকারও আছে।

নোবেল পুরস্কার বিতর্ক

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সু চির রোহিঙ্গা নিধনে চুপ থাকা এবং সামরিক জান্তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে গণহত্যা সমর্থন করায় তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি ওঠে বিশ্বব্যাপী।

২০১৭ সালে চার লাখেরও বেশি মানুষ একটি অনলাইন পিটিশন স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে সু চির নোবেল প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে।

পিটিশনে বলা হয়েছে, “শান্তিতে নোবেল বিজয়ী যখন শান্তি বজায় রাখতে পারেন না তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল কমিটির উচিত তার পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া বা বাজেয়াপ্ত করা।”

Comments

The Daily Star  | English

Govt looking to defuse trade tensions with India

Bangladesh does not want any further escalation in tension with India as the recent retaliatory moves are affecting bilateral trade and both countries’ businesses.

43m ago