‘বিএনপি-জামায়াতের কারসাজি’ ও রাজাকারের তালিকা
রাজাকারের তালিকা প্রকাশ ও স্থগিতের মাঝের সময়ে যা ঘটলো তা আমাদের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জন্যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অতীতে জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়ার নামে লাথি দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর সবগুলো সরকার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে ধারাবাহিকভাবে। অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান করে নিয়ে সন্তান ও নাতি-পুতিদের কোটায় চাকরির সুযোগ নিয়েছিলো।
তবে এবারের রাজাকারর তালিকা প্রকাশের বিষয়টি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনা। অতীতে অভিযোগ ছিলো মুক্তিযোদ্ধা স্থান পাননি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
রাজাকার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পেয়েছে। রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানো হয়েছে। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম, এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে এ (সংশোধিত) তালিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন। একারণেই বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। প্রিয় পাঠক বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করবো আগে-পরের কিছু প্রেক্ষাপট স্মরণ করার।
দৃশ্যপট এক:
ক. ১৯৭১ সাল, রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বরিশালের তপন চক্রবর্তী। যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া রাজাকারদের বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধে তপন চক্রবর্তীদের বিজয়ের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ।
খ. ১৯৭১ সাল, সুনামগঞ্জের তরুণদের সংগঠিত করছেন, উদ্বুদ্ধ করছেন নাজির বখত। জামায়াতে ইসলামী অর্থের বিনিময়ে তৈরি করছিলো রাজাকার বাহিনী। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করছে। নাজিব বখতদের প্রশিক্ষণে এক একজন তরুণ হয়ে উঠলেন অদম্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করে পরাজিত করলেন পাকিস্তান ও তাদের দোসর রাজাকারদের। কতো শত-লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ঝড়ে গেলো যুদ্ধে। সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।
দৃশ্যপট দুই:
গ. ২০১৯ সাল, ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করলো মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। রাজাকারের সেই তালিকায় স্থান পেলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী। রাজাকারের তালিকায় নাম থাকলো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নাজিব বখতের।
দৃশ্যপট তিন:
নিশ্চিত করে বলতে পারি, যারা এই লেখা পড়ছেন তাদের প্রায় সবাই ১৯৭১ সাল, রণাঙ্গন, তপন চক্রবর্তী বা নাজিব বখতদের চোখের সামনে দেখছেন। কারণ সবার পরিবারে বা আশেপাশে এমন তপন চক্রবর্তী বা নাজিব বখত আছেন, যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন।
প্রিয় পাঠক এবার দৃশ্যপট-৩ কল্পনা করুন।
ঘ. মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী, নাজিব বখত আবেদন করছেন:
‘মাননীয় মন্ত্রী
... আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার নই। দয়া করে আমার নাম রাজাকারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছি। মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণ দরখাস্তের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো।’
আপনি পারছেন কল্পনা করতে? কল্পনা করতে পারছেন কী কেউ?
বাংলাদেশে তো কোনো কিছুই অবিশ্বাস্য নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, স্থগিত হয়ে যাওয়া রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পর মুক্তিযোদ্ধাদের এমন নির্দেশনাই দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তার মন্ত্রণালয় থেকে সিনিয়র তথ্য অফিসার সুফি আবদুল্লাহিল মারুফ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিলো:
‘গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিকমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে নতুন কোনো তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকা হতে যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে।’
অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ তালিকায় বেশকিছু নাম এসেছে, যারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিকমিটি বা স্বাধীনতাবিরোধী নন, বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বা মুক্তিযোদ্ধা। এ ধরনের কোন ব্যক্তির নাম তালিকায় কীভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রকাশিত তালিকায় ভুলভাবে যদি কারও নাম এসে থাকে, আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই অন্তে তাঁর/তাঁদের নাম এ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
একজন মুক্তিযোদ্ধা আবেদন করেছিলেনও-
‘গত ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার চেয়ে স্বরাষ্ট্র, আইন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু। বুধবার তিনি এই তিন মন্ত্রণালয়কে ওই তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার ও সংশোধনের আবেদন জানান।’ (ইত্তেফাক, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯)।
ঙ. একটি কাজ করতে গিয়ে, যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে কিছু ‘ভুল’ হতে পারে। শব্দগত, তথ্যগত, নামগত... ভুল হতে পারে। সংবাদমাধ্যমে আমরাও কিছু ভুল করি। ভুল সংশোধন করি, দুঃখ প্রকাশ করি। কিন্তু, আমরা এখন কোনটি ‘ভুল’ আর কোনটি ‘অপরাধ’ তা গুলিয়ে ফেলছি। যেমন সরকারের কোনো একটি কাজের সমালোচনাকে দেশের সমালোচনা হিসেবে দেখছি।
বাংলা ভাষায় অপমান-অসম্মান-বিষোদগার করার বহু শব্দ আছে। এক্ষেত্রে ’রাজাকার’ শব্দের চেয়ে শক্তিশালী কোনো শব্দ নেই। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘রাজাকার’র আভিধানিক অর্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ‘রাজাকার’ বলে যতোটা অপমান-অসম্মান বা অপরাধী বা ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করে তা করা যায় না। একথা সত্যি যে, ঘৃণা ছড়ানো কোনো সমাজ বা দেশের জন্যে মঙ্গলজনক নয়। তা বিবেচনায় রেখেই বলছি, একাত্তরের বাংলাদেশবিরোধী জামায়াত ও তাদের গঠন করা রাজাকার-আলবদর-আল শামস অবশ্যই ঘৃণার পাত্র।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা যারা করেছিলো, পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে যারা অপরাধ করেছিলো তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের ভাষা ‘রাজাকার’।
আর ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বাঙালির শ্রেষ্ঠ শব্দ, শ্রেষ্ঠ সন্তান।
সেই ‘রাজাকার’ শব্দ রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা’র নামের আগে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাকে আখ্যায়িত করছে ‘রাজাকার’ নামে। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাকে ২০১৯ সালে দেওয়া ‘রাজাকার’ উপাধি কাটানোর জন্যে আবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হলো!
২.
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আগে থেকেই প্রচারণা চালাতে দেখা গেলো। এই মন্ত্রণালয় বেশ আওয়াজ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে গিয়ে কতোটা হযবরল অবস্থা করেছিলো, তা দেশের মানুষের দেখার সুযোগ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে রাজাকারের তালিকা তৈরি করেছে, তা জানা যায়নি। হঠাৎ করে তারা রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে সংবাদ শিরোনাম হলো। কৃতিত্ব খুব বেশি সময় উপভোগ করতে পারেনি।
রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসার পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বললেন, রাজাকারর তালিকা আমরা করিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যে তালিকা দিয়েছে, সেই তালিকা আমরা প্রকাশ করেছি। উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজাকারের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে দেয়নি।
এবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বললেন, ‘রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নামের বিষয়টি বিএনপি-জামায়াতের কারসাজি। তারা যখন ক্ষমতায় ছিলো, তখন রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম লিখে রেখে গেছে। (দ্য ডেইলি স্টার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯)।
আপনারা কী করলেন, কী করেন? না দেখে, না বুঝে একটি তালিকা প্রকাশ করে দিলেন? বিএনপি-জামায়াত এমন অন্যায় করে গেছে কী না, তাও তদন্ত করে প্রমাণের বিষয়। তা না করে বল আরেক প্রতিপক্ষের দিকে ঠেলে দিলেই কী দায়মুক্ত হওয়া যায়?
মন্ত্রিত্ব তো কোনো শিক্ষানবিস পদ নয়। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো? এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করা হয়েছে অত্যন্ত অযত্ন-অবহেলায়। দুটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সামান্যতম কোনো সমন্বয় নেই। মাঠ পর্যায়ে কোনো অনুসন্ধান নেই। নেই কোনো গবেষণা। কোনো তথ্য সংগ্রহই করা হয়নি। যাচাই-বাছাই তো দুরের বিষয়। এই সক্ষমতা নিয়ে স্থগিত করা রাজাকারের তালিকা ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশ করা হতে পারে। এই তালিকা থেকে পরিচিত কিছু নাম বাদ দিলেই সুষ্ঠু রাজাকারের তালিকা হয়ে যাবে? বিষয়টি এতো সহজ!
৩.
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীনের মতো অসাধ্য সাধন করা জাতি। সেই জাতির নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক-শুদ্ধ তালিকা করতে পারেনি। বহু মুক্তিযোদ্ধা রয়ে গেছেন তালিকার বাইরে। বহু রাজাকার ঢুকে গেছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। রাজাকারের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। এর কারণ কী? অভাব কীসের? সক্ষমতা না আন্তরিকতার? কোনো সন্দেহ নেই মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারের সঠিক-শুদ্ধ তালিকা করা সহজ বিষয় নয়। কিন্তু, তা এতোটা কঠিন নয় যে এমন তালগোল পাকিয়ে ফেলতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারের তালিকা করার আগে রাজনৈতিক বিবেচনা সম্পূর্ণ পরিহার করে ‘নির্মোহ’ শব্দটি আত্মস্থ করতে হবে। তালিকা প্রণয়নের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে মাঠ পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের এখনকার পরিচিতি আওয়ামী লীগ-বিএনপি-বাম, যাই হোক না কেনো। জেলা প্রশাসক নির্ভর তালিকা কখনো সঠিক-শুদ্ধ হবে না। আর যদি ধরেই নেই যে, সঠিক-শুদ্ধ তালিকা করার সক্ষমতা আমাদের নেই, তবে বিরত থাকাই শ্রেয়।
শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান দিতে না পারি, অসম্মান করা থেকে বিরত তো থাকতে পারি।
Comments