এই কী সেই শীর্ষ সন্ত্রাসী জয়?

ডেইলি স্টার এবং কানাডার গ্লোবাল নিউজ যৌথ তদন্তে ভারতীয় ব্যবসায়ী তারেক রানা এবং বাংলাদেশের কুখ্যাত অপরাধী চক্র সেভেন-স্টার গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীর ইসলাম জয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পেয়েছে।

ডেইলি স্টার এবং কানাডার গ্লোবাল নিউজের যৌথ তদন্তে ভারতীয় ব্যবসায়ী তারেক রানা এবং বাংলাদেশের কুখ্যাত অপরাধ সিন্ডিকেট সেভেন-স্টার গ্রুপের নেতা তানভীর ইসলাম জয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পেয়েছে। জয় ১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশে পুলিশি অভিযানের সময় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এবং হাজারীবাগ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের রক্ত হিম করে দিতে জয়ের একটি ফোন কলই যথেষ্ট ছিল।

সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ এবং মুরগি মিলনের মতো পেশাদার অপরাধীদের নিয়েই ছিল তার সেভেন স্টার গ্রুপ।

ফাইভ-স্টার গ্রুপ এবং সেভেন-স্টার গ্রুপ নব্বইয়ের দশকে রাজধানী এবং এর আশেপাশের এলাকায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এদের মধ্যে পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর এবং ডাকাত শহীদের  নেতা ছিল জিসান আহমেদ। জিসান দুবাইয়ে গত বছর গ্রেপ্তার হয়।

জয় প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে পরিচয় দিয়ে সে সাভার ইপিজেড এবং পাশের পর্যটনের এলাকা থেকে চাঁদা দাবি করত। দ্য ডেইলি স্টারে ৪ জানুয়ারি ১৯৯৯-এ এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

তার লক্ষ্য থাকত মূলত ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ী, রিয়েল এস্টেট দালাল এবং শপিং কমপ্লেক্সগুলো। এসবের মালিকদের কাছে থেকে হুমকি দিয়ে কয়েক লক্ষ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা চাওয়া হতো। চাঁদা দিতে বাধ্য করার জন্য তার লোকজনকে পাঠাতো ভয়ভীতি দেখাতে। কিন্তু, কেউ যদি টাকা না দিত তাহলে ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করা হতো।

এই দুই অপরাধ গ্যাং এতটাই ভয়ভীতি দেখানো শুরু করে সবাইকে যে শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এদের ২৩ জনকে ২০০১ সালের ২৭ ডিসেম্বর মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধী ঘোষণা করে।  এই দুই গ্যাংয়ের প্রধান জয় এবং জিসানকে ধরিয়ে দেওয়া বা তাদের ধরিয়ে দিতে সহায়ক তথ্য দিতে এক লাখ এবং ৫০ হাজার টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়।

এই ঘোষণার পরই তারা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পায়।

কিন্তু এতে ব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়া বন্ধ হয়নি, তা আরও বেড়েছে। ঘোষণার পরও জয় কমপক্ষে তিনটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড, একাধিক চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল।

এ অবস্থা চলতে থাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এই অপরাধীদের নাম ইন্টার পোলের লাল তালিকা ভুক্ত করে। তবে এখন পর্যন্ত ২৩ জনের মধ্যে জয় সহ ১৩ জনের হদিস খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দ্য ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ঢাকা ধারনা করছিল জয় অস্ট্রেলিয়াতে পলাতক আছে। গত বছরের ৮ নভেম্বর ক্যানবেররায় ইন্টারপোলে কাছে তার অবস্থান বের করার জন্য অনুরোধ করেছিল।

বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক এবং ইন্টারপোলের সঙ্গে বাংলাদেশের লিয়াজোঁ অফিসার মহিউল ইসলাম জানান, তাদের আবেদনের  পরের দিন এনসিবি-ক্যানবেররা জানায় জয় অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে এমন কোনো তথ্য নেই।

তিনি আরও জানান, “সিদ্ধান্ত মত মোস্ট-ওয়ান্টেড পলাতকদের তালিকায় তাকে শীর্ষে রাখা হয়েছে।”

জুন থেকে শুরু করে তিনটি দেশে ছয় মাস ব্যাপী তদন্ত করে দ্য ডেইলি স্টার এবং কানাডার গ্লোবাল নিউজ জয়ের সাদৃশ্য এক ব্যক্তির সন্ধান পায়।

জি সেন্টারে ২৪ এপ্রিল ২০১৯-এর একটি ছবি। ছবিতে আছেন এজাক্সের মেয়র শন কলিয়ার (ডানে), তারেক রানা (ডান থেকে দ্বিতীয়), এজাক্সের কাউন্সিলর আসমিদ খান (মাঝে), কানাডা সরকারের চিফ হুইপ মার্ক হল্যান্ড (বা থেকে দ্বিতীয়) এবং কানেক্টিং জিটিএ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুরেশ কুমার (বামে)। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

তার কানাডার জীবন

ভারতের কলকাতার নাগরিক মো. তারেক রানা পাঁচ বছর আগে কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে সুনাম অর্জনের জন্য খুব বেশি সময় লাগে নি তার। তিনি টরন্টোর পূর্ব দিকের শহর অ্যাজাক্সে একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থা করেন। সেখানে থেকে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তা এবং সমাজসেবী হিসাবে নিজের নামডাক তৈরি করেন।

তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালে এজাক্সের উদীয়মান উদ্যোক্তা বেশ কিছু পুরস্কার নিজের ঝুলিতে ভরেন।

কানাডার রাজনীতিবিদ আহমেদ হুসেন সেদেশের অভিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তারেক রানার সঙ্গে উঠানো ছবিতে তাকে দেখতে অনেকটা জয়ের মতোই লাগে।

বিস্ময়কর ভাবে রানা এবং জয়ের জন্ম তারিখ, উচ্চতা, স্বাস্থ্য সমস্যা এমনকি  উচ্চ বিদ্যালয়ও একই যেখানে তারা পড়াশোনা করেছে।

জুলাইয়ে অ্যাজাক্সে রানার অফিসে জয়ের ইন্টারপোলের কাচে পাওয়া ছবি দেখালে গ্লোবাল নিউজকে বলেছিলেন, “আমি এই লোক না।”

তবে তিনি স্বীকার করেন যে পলাতক ব্যক্তির মতোই তিনি দেখতে এবং রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশও (আরসিএমপি) এ বিষয়টি জানিয়েছে।

তিনি বলেন, “এই ব্যক্তির চেহারা আমার সঙ্গে অনেক মিল। কিন্তু, গত আড়াই বছর ধরে এই ব্যক্তির সঙ্গে আমার চেহারার মিল থাকায় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।”

কলকাতার জীবন

বাংলাদেশের পুলিশের তালিকায় নাম আসার পর জয় কোনো এক সময় মালয়েশিয়া পালিয়ে যায়। এরপর ১০ জুন ২০০৩ এ দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০০৩ এ কলকাতায় আসেন।

২০০৭ সালে ১৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ কলকাতার কসবা পেট্রোল পাম্প থেকে ছয়জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের কাছ থেকে তিনটি সন্দেহভাজন ভারতীয় পাসপোর্ট জব্দ করে। পুলিশের কাছে তারা স্বীকার করে যে, গোপন পথ দিয়ে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই তারা ভারতে প্রবেশ করেছে।

আদালতের তথ্য অনুসারে তারা পুলিশকে জানিয়েছিল, সেভেন-স্টার গ্যাংয়ের একজন নেতাও সে শহরে ‘জাল নথি’র সাহায্য নিয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন।

২০০৭ সালে জয় সন্দেহে গ্রেপ্তার করা একজন ব্যক্তি নিজেকে রানা বলে দাবি করেন।

আদালতে তিনি নিজেকে করদাতা ভারতীয় পোশাক ব্যবসায়ী হিসাবে উপস্থাপন করেন। আদালতকে তার আইডি এবং ব্যবসায়ের নথি দেখান মো. তারেক রানা হিসেবে। তিনি গাউস ফ্যাশন এবং জি ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী হিসেবে উপস্থাপন করেন।

তিনি ২০০৪ সালে ইস্যু হওয়া একটি ভারতীয় ড্রাইভিং লাইসেন্সও দেখান যেখানে তার নাম রয়েছে তারেক রানা। এছাড়াও ২০০৫ সালে ইস্যু করা একটি ভারতীয় পাসপোর্ট দেখান যার মাধ্যমে তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন।

তখন, রানা অসুস্থ থাকায় আদালতে এ মামলার শুনানি সাময়িক বন্ধ থাকে। এই যৌথ তদন্ত থেকে এটা জানা সম্ভব হয় নি যে, সেই মামলায় পরবর্তীতে কি হয়েছিল।

এই মামলার দায়িত্বে থাকা এক ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা এই যৌথ তদন্তকারীদের জানান যে, রানা নিজেকে জয় বলে স্বীকার করেছিলেন। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে ২০০৮ সালের জুনে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং সে বছরই ডিসেম্বরে নিখোঁজ হয়। সে নিখোঁজ হওয়ায় পুলিশকে দোষারোপ করে তার পরিবার।

এরপর থেকেই ঢাকায় জয়ের ত্রাসের খবরও শেষ হয়ে গেল।

কানাডার সাবেক অভিবাসন মন্ত্রী আহমেদ হুসেনের সঙ্গে তারেক রানা। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহিত।

কানাডায় ডেরা

রানার পাসপোর্ট অনুযায়ী সে কলকাতা থেকে মালয়শিয়া যায়। ২০০৬ সাল থেকেই মালয়েশিয়ার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রোগ্রামের আওতায় সেদেশের নাগরিক সে।

প্রথমবার রানা কানাডায় যায় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ভিসা নিয়ে। সেখানে কিছু দিন থেকে ফিরে আসে, এবং পুনরায় কানাডায় বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়ে ভিসার আবেদন করে। কিন্তু, তার সেই ভিসা বাতিল হয় পড়াশুনার কমতি থাকায়।

কাকতালীয় ভাবে, বাংলাদেশের সিআইডির কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী জয় দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে।

পরবর্তীতে তিনি দশ বছরের ভ্রমণ ভিসার জন্য আবেদন করেন সিংগাপুরে কানাডিয়ান দূতাবাসের মাধ্যমে। এবং ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভিসা পান।

ভিসা পাওয়ার ১৫ দিন পর তিনি কানাডায় যান।

এসজে৭১-এর প্রেসিডেন্ট তারেক রানা তার আজাক্সের ১৫ হারউড এভিনিউয়ের অফিসে। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহিত

রানা কানাডায় যাবার পর সেখানে কাজের জন্য ভিসা পাওয়ার আবেদন করলে জয়ের বিষটি সামনে আসে। কিন্তু সে এবং তার আইনজীবী কর্তৃপক্ষতে বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি জয় নন। এমনকি তার আঙ্গুলের ছাপ কোন অপরাধীর সঙ্গে মিলে নি।

বাংলাদেশে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে তৈরি ডাটাবেজের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে। যার আট বছর আগেই জয় পলাতক  হয়।

 

(সংক্ষেপিত, বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে)

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago