‘একটি লাশ চেয়েছিলো বোধ হয়’

VC-and-VP.jpg
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। ছবি: স্টার

শিরোনাম দেখে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন মনে করবেন না। কবিতার কথা বলছি না, বলছি সন্ত্রাসের কথা। বলছি ডাকসুর কথা। কতো সফল সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে এই সংগঠন, কতজনকে জাতীয় নেতা বানিয়েছে ডাকসু!

ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর। এবার সেই ডাকসু ভবনে ভিপির রুমে লাইট বন্ধ করে দিয়ে ভিপিকে পেটানো হলো। পেটানো হয়েছে রড, লাঠি ও বাঁশ দিয়ে। সংবাদপত্রে যেভাবে স্থান পেয়েছে এই পেটানোর সচিত্র সংবাদ:

‘রবিবার দুপুর পৌনে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ডাকসু কার্যালয়ে ভিপি নুরের কক্ষে ও ভবনের সামনে এই বর্বর হামলা চালানো হয়। ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের শতাধিক নেতাকর্মী নুরের কক্ষে ঢুকে লাইট বন্ধ করে হাতুড়ি, রড, লাঠি ও বাঁশ নিয়ে হামলা চালায়। পিটুনির একপর্যায়ে ভিপি নুর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে দেখা গেছে। এছাড়া একজনকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় ডাকসু ভবনের কাচ ভাঙচুর করে হামলাকারীরা। পরে ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানীকে আহতদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে, তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভিপি নুর বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, তা বিবেচ্য নয়।’ (ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯)।

আওয়ামী লীগের সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক। আহতদের হাসপাতালে দেখতে গিয়ে এই হামলার ঘটনাকে ‘পৈশাচিক-বর্বর’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এই ‘পৈশাচিক-বর্বর’ হামলা যারা করেছে তাদের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ এবং ছাত্রলীগ। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বাঙালির আবেগ-অনুভূতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম। হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’র নামে। আর ছাত্রলীগ? তারও গৌরবময় ঐতিহ্য আছে, বর্তমান অন্ধকার আর ভবিষ্যৎ অস্বচ্ছ।

যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের বক্তব্য এবং গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ এবং ‘ছাত্রলীগ’ রড, লাঠি ও বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ এবং ‘ছাত্রলীগ’ দাবি করেছে তারা নিষ্পাপ। ভিপি নুরের কক্ষে আলো নিভিয়ে তাকে পেটানোর ঘটনা ছাড়া, অন্য দৃশ্যগুলোর ভিডিও চিত্র আছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো কিছু দেখিয়েছে, ইউটিউবে কিছু আছে। সেগুলো পর্যবেক্ষণ করলে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ এবং ‘ছাত্রলীগ’ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কারণ এসব ভিডিও চিত্রে যারা রড, লাঠি ও বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে তাদের অনেককে চেনা যায়। আক্রান্তরা সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নাম ধারণকারী রড, লাঠি ও বাঁশ বাহিনীর অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী-ক্যাডার।

জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং বাহাউদ্দিন নাসিম হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে বলেছেন, ‘সে যে মঞ্চই হোক, যে মঞ্চের নামেই গোলযোগ করুক না কেনো, কাউকে বর্তমান সরকার রেহাই দিবে না। শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্যে তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

ভিপি নুরের ওপর ২২ ডিসেম্বরের হামলার পাঁচ দিন আগে এই ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ই তাকে পিটিয়ে আহত করেছিলো। সেই সন্ত্রাসী হামলারও ভিডিও ফুটেজ আছে। এর আগে, গত কয়েক বছরে নুর ও তার সহযোগীদের ওপর কমপক্ষে আটবার সন্ত্রাসী হামলা করেছে ছাত্রলীগ। তারও অনেকগুলোর ভিডিও ফুটেজ ছিলো।

কোনো সন্ত্রাসী-রক্তাক্ত হামলার তদন্ত বা বিচার হয়নি। প্রশাসন বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেউই কিছু করেনি। এখন দেখার বিষয় নানক-নাসিমের প্রতিশ্রুতি কতোটা বাস্তবায়ন হয়।

ভিপি নুর ও তার সহযোগীদের হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন উপাচার্য, ডাকসু সভাপতি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান ও প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। দৃশ্যটি কিছুটা ব্যতিক্রমী। এর আগের হামলার পর আহত নুরদের দেখতেও যেতেন না উপাচার্য বা প্রক্টর।

ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, উপাচার্য ও প্রক্টর হাসপাতালে আহত-রক্তাক্ত নুরের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর পর আহতরা উপাচার্যকে বলতে থাকেন, “স্যার আমাদের চারজনকে পেটানোর পর ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে।”

একথা শুনে উপাচার্য নুরের দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোমাকে এক ঘণ্টা আটকে রাখছে কেনো? ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছো মনে হয়। তোমাকে আটকে রেখে একটি লাশ চেয়েছিলো বোধহয়।”

তখন আহতদের কয়েকজন উপাচার্যকে বলেন, “স্যার নুরকে যখন রুম আটকে মারা হচ্ছিলো, তখন আমরা কয়েকজন দৌড়ে প্রক্টর স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম স্যার নুরকে বাঁচান।”

প্রক্টর স্যার উল্টো আমাদের ধমক দিয়ে বলেছেন, “তোমরা ওখানে গেছো কেনো? তোমাদের বহিষ্কার করে দেবো।”

তখন প্রক্টর বলেন, “তোমাদের নিষেধ করেছি যেতে। তোমরা গেছো কেনো?”

আহতরা বলেন, “আমরা না গেলে তো স্যার নুরকে মেরে ফেলতো। তারা মনে করেছিলো নুর মারা গেছে। মারা যাওয়া নিশ্চিত হয়ে তারা রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। যারা মেরেছে তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ভিডিওতে সব প্রমাণ আছে।”

প্রক্টরকে তখন উপাচার্যের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

এই সেই বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্ববিদ্যালয় পুরো বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করতে শিখিয়েছে। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর-অধ্যাপক ‘মাথা নিচু’ করে সন্ত্রাসের দায় নিজের কাঁধে নিচ্ছেন। সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

সেই সময় উপাচার্যকে বলতে দেখা যায়, “আমাকে একজন দেখালো সেখানে কয়েকজন ‘বহিরাগত’ ছিলো।”

এতো অভিযোগ শোনার পর উপাচার্য যে ‘বহিরাগত’ খুঁজছেন, ছাত্রলীগও সেই ‘বহিরাগত’ বিষয়ক অভিযোগই এনেছে নুরদের বিরুদ্ধে। উপাচার্য নুরদের বলেছেন “তোমাদের কাছে বহিরাগত আসে কেনো?”

ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী অভিযোগ করেছেন, নূর অস্ত্র-সস্ত্রসহ বহিরাগতদের ডাকসু ভবনে ঢুকিয়েছে।

নুর বা তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসী আছে বা তাদের কাছে অস্ত্র আছে, এ কথা তো কেউই বিশ্বাস করবেন না। ফলে সেই আলোচনায় না যাই। ‘বহিরাগত’ প্রসঙ্গে আসি।

নুরুল হক নুরদের সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’। ঢাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ কমবেশি সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের সংগঠনের কার্যক্রম আছে। নুর ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা-কর্মীরা নুরের সঙ্গে দেখা করতে ও কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ডাকসু ভবনে নুরের কক্ষে আসেন। তাদের কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়, এ কথা সত্যি। কিন্তু ‘বহিরাগত’ হিসেবে তাদের যেভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, আসলে কি বিষয়টি তেমন? নুরদের কাছে যারা আসেন তাদের একজনেরও পরিচিতি সন্ত্রাসী নয়। আজ পর্যন্ত তেমন কোনো অভিযোগ বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদের প্রায় সবাই ছাত্রছাত্রী, দেশের অন্যান্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ, বামসহ যতগুলো ছাত্র সংগঠন আছে, তাদের সবার কর্মসূচিতে অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতা-কর্মীরা আসেন। ছাত্রলীগের প্রায় প্রতিটি কর্মসূচিতে ঢাকা কলেজ ও ইডেন থেকে নেতাকর্মীরা যোগ দেন। এই যোগ দেওয়াটা নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে এই রীতি চলে আসছে। সব সময় সব কর্মসূচিতে অন্যান্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাকর্মীরা আসেন। তাদেরকে ‘বহিরাগত’ বলে রড, লাঠি, বাঁশ দিয়ে পেটাতে হবে? ছাদ থেকে ফেলে দিতে হবে? এতো অভিযোগ, এতো তথ্য ভিডিও চিত্র থাকার পরও উপাচার্য শুধু ‘বহিরাগত’দেরই দেখলেন? যারা রড, লাঠি, বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছিলো, তাদের দেখলেন না? চিনলেন না? মাননীয় উপাচার্য, আপনার ‘একটি লাশ চেয়েছিলো’ কারা? অভিযোগ কার বিরুদ্ধে করছেন? যারা মার খেয়ে লাশ হতে যাচ্ছিলো, আপনার অভিযোগ কী তাদের বিরুদ্ধে, না যারা মারছিলো তাদের বিরুদ্ধে?

নুরকে যখন রুমে আটকে লাইট বন্ধ করে নির্দয়ভাবে পেটানো হচ্ছিলো, সংবাদ জেনেও প্রক্টর কেনো সেখানে গেলেন না? নূরের সহকর্মীদেরও কেনো প্রক্টর যেতে নিষেধ করছিলেন? যারা নুরকে বাঁচাতে গেলেন, তাদেরকেই কেনো বহিষ্কারের হুমকি দিলেন প্রক্টর?

উপাচার্যের ‘একটি লাশ চেয়েছিলো বোধহয়’ বক্তব্যের তাৎপর্য কী?

লাশ কে বা কারা চেয়েছিলো?

নুর বলছেন, ছাত্রলীগ তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে।

‘ভিপি নুর বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তা বিবেচ্য নয়’ ডাকসু জিএস গোলাম রাব্বানীর কাছে। চোখে সানগ্লাস ও জ্যাকেট পরিহিত গোলাম রাব্বানী (২২ ডিসেম্বর) বলছিলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নুরকে আর ডাকসু ভবনে ঢুকতে দেওয়া হবে না।”

এই সেই গোলাম রাব্বানী যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে (৬%, ৮৬ কোটি টাকা) চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। এই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এনেছিলেন জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নিজে। অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম এই অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন। এই চাঁদা দাবির অভিযোগেই ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো গোলাম রাব্বানীকে। এমন নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগে অভিযুক্ত গোলাম রাব্বানীকে ডাকসু সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছিলো। ডাকসু নির্বাচনের আগে নিয়মবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ভর্তির অভিযোগে যারা অভিযুক্ত, রাব্বানী তাদের অন্যতম।

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের পদ হারিয়ে কয়েক মাস নীরব থেকে, আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন রাব্বানী।

বুয়েটে আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলার পর, বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো শিক্ষাঙ্গন। মৃত ভেবে হামলাকারী সন্ত্রাসীরা চলে গেলেও, নুর এবারও মারা যাননি। তুহিন ফারাবীর লাইভ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়েছে, এটাও কিছুটা স্বস্তির সংবাদ। কিন্তু এই ধারাবাহিক আক্রমণ থেকে নুর, ফারাবী, সুহেলরা কয়বার বেঁচে যাবেন? আর কতো বছর, আর কতোবার উপাচার্য-প্রক্টরদের মুখ থেকে দেশের মানুষ শুনবেন “লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে”! নুরদের পরিণতি আবরার না হওয়া পর্যন্ত, এভাবেই কী চলতে থাকবে সবকিছু? এই কী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন বিবেকবান শিক্ষক সমাজ?

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

7h ago