শিশুর মর্যাদা ও বিদ্যালয়
মানব সমাজের মধ্যে বর্ণ, গোত্র, ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে এক ধরেনের বিভেদ তৈরি হয়েছে। এই সব ছাড়াও ধনী-দরিদ্র, বোকা-বুদ্ধিমান ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভেদ বৈষম্য করা হয়। ভিন্ন আর এক বিভেদ হলো বয়সভিত্তিক। এই বিভেদ অনুসারে শিশুরা কমবয়সীদের দলে। জাতিসংঘের হিসাবে শূন্য থেকে আঠারো বছর বয়সের জনগোষ্ঠীকে শিশু বলা হয়।
এই দলের মধ্যে কিছু উপবিভাজনও আছে- শিশু, বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী ইত্যাদি। এখানে অপেক্ষাকৃত ছোটদের শিশু বলা হয়েছে। এই উপবিভাজনের প্রচলন ইংরেজিতেও রয়েছে, যেমন- টডলার, ইনফ্যান্ট, চাইল্ড, বেবি, টিন, এডলসেন্ট ইত্যাদি। একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের সব শিশু একই সুযোগ পায়। সেটা হলো, রাষ্ট্র ও পরিবার তথা সমাজ ওদের দেখভাল করে, অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ও নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়াও ‘মানুষ করার’ দায় নেয়।
শিশুর বাবা-মা ওদের অভিভাবকত্বের দায় নিয়ে ওদের ভাবনা ভাবেন। মানব প্রজাতি টিকে থাকার এটাই প্রাকৃতিক বিধান যে, মা-বাবা শিশুর অভিভাবক। বয়সে বড় এই অভিভাবকের দল ভালোবাসা-আদর-যত্ন দিয়ে শিশুদের নির্বিঘ্নে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করেন নিজেদের মতো করে। শিশুর স্বকীয়তা বা বৈশিষ্ট্য তাদের ভাবনা থেকে প্রায়শই দূরে থেকে যায়। সহজাত স্বভাবেই শিশুরা স্বপ্ন দেখে। তবে বড়দের বিবেচনায় তা আকাশকুসুম কল্পনা, শিশুর সেই স্বপ্ন সেখানেই আটকে থাকে এবং এক পর্যায়ে বিলীন হয়ে যায়। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই যে, মা-বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের দায়ভার নিয়েই শিশুরা বেড়ে ওঠে।
আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বিদ্যালয়গামী শিশুর সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। শিশুর শিক্ষা ও পুষ্টির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উদ্যোগ ইতিবাচক। শিশুর মৌলিক চাহিদা মেটাবার কার্যকরী উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত ও বিভিন্ন ধরনের বিশেষ শিশুদের জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে, বেসরকারি উদ্যোগও কম নয়। ধীরে ধীরে সামাজিক সচেতনতাও তৈরি হচ্ছে। তবে যে প্যারামিটার থেকে উন্নয়নের মাপকাঠি তৈরি হয়েছে, সেখানে মানবিক উন্নয়নের বিষয় খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বহুবিধ কর্মযজ্ঞের ডামাডোলে দক্ষ ও মানব সম্পদের যে ব্যাখ্যা ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে শিশুর স্বকীয়তা ও মর্যাদার বিষয় উপেক্ষিত।
শিশুর মর্যাদা ও প্রচলিত কিছু দৃষ্টিভঙ্গি
বছর বারো আগে একটি বিদ্যালয়ের ছাদ থাকে লাফ দিয়ে একটি কিশোরী আত্মহত্যা করেছিলো। কারণ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেয়েটিকে তার কক্ষে ডেকে পরীক্ষায় নকল করার মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলেন। মেয়েটি আত্মমর্যাদায় আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলো। ‘শিশুর মর্যাদাবোধ’ এমন একজোড়া শব্দ যা আমাদের কাছে তেমন একটা পরিচিত নয়। শিশুর অধিকারের কথা শোনা যায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু দিবসে। সেখানে শিশুকে ভালো রাখার, আনন্দে রাখার চটকদার কিছু আয়োজনের কথা হয়, কিন্তু সেখানে শিশুর মর্যাদা রক্ষার প্রসঙ্গ উহ্য থেকে যায়। সরকারি বা বেসরকারিভাবে শিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণের কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়, কিন্তু শিশুর মর্যাদা ও সম্মানের প্রসঙ্গ আলোচনার বাইরেই থেকে যায়।
শিশুপীড়নের হার সম্ভবত বেড়েছে। এ নিয়ে আবার মতান্তরও আছে। অনেকের মতে, অতীতের সামাজিক অবস্থা এমনই ছিলো, কেবল তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এসব সংবাদ আমরা জানতে পারছি বলেই শিশুপীড়নের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে হয়। তবে অপর্যাপ্ত হলেও শিশুপীড়ন বন্ধের বহুবিধ উদ্যোগ ও সামাজিক সচেতনতার কাজ হচ্ছে। শারীরিক পীড়ন ছাড়াও মানসিক বা মৌখিক পীড়ন বন্ধ করতে দেশে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। কিন্তু ভিন্ন এক ধরনের পীড়নের অস্তিত্ব আছে পরিবারের মধ্যেই। এর নাম ভালোবাসার পীড়ন। অনেক মা-বাবা-অভিভাবক পালনকর্তা হিসেবে বা ভালোবাসেন বলে অনেক কিছুই শিশুর উপরে চাপিয়ে দেন। সেখানে শিশুর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যও মর্যাদা বিবেচনায় আসে না। শিশুর ‘রেয়ারিং’ হচ্ছে না, হচ্ছে ‘গ্রুমিং’।
প্রচলিত সামাজিক বিধান ও ধর্মীয় শিক্ষায় নানাভাবে বয়োজ্যেষ্ঠদের মান-মর্যাদার কথা বলা হয়েছে- মা-বাবা, শিক্ষক-গুরুজনদের সম্মান দেখানোর নানা আচার-অনুষ্ঠান বা প্রথার প্রচলন আছে। কিন্তু শিশুর প্রতি বড়দের আচরণের যে সংস্কৃতি আমরা ঠিক বলে জানি, সেখানে দয়া, মায়া, করুণা, স্নেহ, ভালোবাসা, সেবা ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে আছে। শিশুকে সম্মান করা বা তার মর্যাদার স্বীকৃতির কথা সেখানে নেই। শিশুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আমাদের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে খাপছাড়া।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুর মর্যাদা
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য চাকুরী বা সচ্ছল জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা, যাকে আমরা বলি সফল জীবন। এর ফলে অতি শৈশব থেকেই বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন শিশুদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্যে উপযুক্ত মানের সনদের মোহে শিক্ষা মানে নম্বরের হিসাব-নিকাশ শিশুর লেখাপড়ায় কোনো নির্মোহ নির্মল আনন্দের অবকাশ নেই, শিশুর পাঠক্রমে বা পাঠপদ্ধতিতে আনন্দযোগ অপ্রাসঙ্গিক।
শিশুশিক্ষার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার লক্ষ্যই যেনো নিরক্ষরতার অভিশাপ মোচন। উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যে শিক্ষাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে শিশু উচ্চতর শিক্ষায় প্রবেশ করে, সে পদ্ধতিতে শিশুর কিছু জানা হয় বটে, কিন্তু শেখার ক্ষমতা খর্ব হয় অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়গামীদের ভাষাজ্ঞান, অনুধাবন ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতার অভাবের কথা ইদানীং অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে।
বহুবিধ প্রকারের বিভেদ তৈরি করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। ধর্ম ও অর্থনৈতিক বিভাজন তো এদেশে সামাজিকভাবে প্রচলিত বহুযুগ ধরেই। বিদ্যালয়গুলোতে আরও যুক্ত হয়েছে মেধা ও সংস্কৃতিভিত্তিক বিভাজন। মানমর্যাদার সবটাই ‘ফার্স্ট বয়’দের জন্যে সংরক্ষিত থাকে।
সমস্যা অনুধাবন ও উত্তরণ সন্ধান
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অস্ট্রিয়ান জীববিজ্ঞানী কনরাড লোপেজ মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, মানুষ শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক শক্তির অপব্যবহার করে নিজেকে ধ্বংস করবে না এবং উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবী মানুষের বসবাসের উপযুক্ততাও হারাবে না। কিন্তু এই প্রজাতির বিলুপ্ত হবে তারই সৃষ্ট সভ্যতার সংকট থেকে। সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার উপক্রম থেকে এই সংকট।
আমরা জানি, সামাজিক বন্ধনই মানব সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি। এর থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারলে মানব প্রজাতির আয়ু খুব কম। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে এখনই মূল্যবোধের প্যারামিটার পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
অনেকের মধ্যে শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ এখন আর নেই। ওর প্রাকৃতিক পরিবেশে নেই, নিসর্গ আলো হাওয়ার খুব অভাব। অতীতে অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে বা যৌথ পরিবারে শিশুরা বেড়ে ওঠায় তাদের মধ্যে এক প্রকার সামাজিক বোধ জাগ্রত হতো। এই যুগের পরিবার এমন সুযোগ আর দিতে পারছে না। দক্ষ নাগরিক হওয়ার জন্যেও শিশুকে সামাজিক মানুষ হয়ে উঠতে হবে। যা অত্যন্ত জরুরি এবং এখনই শুরু হওয়া প্রয়োজন, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রান্তিক মূল্যায়নের পদ্ধতি ও মাপকাঠি পাল্টানো। জ্ঞান অর্জন ও জীবনের জন্য তৈরি হওয়ার বহুবিধ দক্ষতা অর্জন করবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। আগে প্রয়োজন সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস, যা শিশুর প্রতি উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণের মধ্যেই নিহিত।
বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত্তি প্রথাগত গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের নয়। বরং শিক্ষকরাও কর্মী, তিনি শিশুদের দলের একজন হয়ে কাজ করবেন নির্মল আনন্দে, শিক্ষানবিশের মতো। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার আয়োজনে শিক্ষক স্যার বা ম্যাডাম না হয়ে ভাইয়া বা আপা হতে পারেন, সম্পর্কের দূরত্ব তাহলে কমে আসবে। পরম্পরাগত যে মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক, তা এখন আত্মপ্রতারণাপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া বেশি কিছু নয়।
পরম্পরাগত এই মূল্যবোধের ওপর শ্রদ্ধাশীল থেকেই শিশুর মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে শিশুশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। প্রথাগত পদ্ধতির পরীক্ষা, নম্বর-প্রত্যাশী শিক্ষার্থীর কোচিং সেন্টার নির্ভরতা, বাড়ির কাজের বোঝা, বিশাল বড় স্কুলব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছে চারদিকে। সমাজের বয়স্কজনদের ছোটদের মধ্যে মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব নেওয়ার সময় হয়েছে। বড় ও ছোটদের মধ্যে সম্মান প্রদর্শনের রীতি একমুখী না হয়ে দ্বিমুখী হতে হবে। শৃঙ্খলার নামে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিধিনিষেধের ছাঁচে ঢালা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আমাদের।
সিদ্দিক বেলাল, শিক্ষাকর্মী, সহজপাঠ উচ্চ বিদ্যালয়
Comments