রেলওয়ের হাসপাতালটি যেনো নিজেই রোগী
চার বছরেরও বেশি আগে সরকার কমলাপুরের রেলওয়ে হাসপাতালকে উন্নত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। লক্ষ্য ছিলো, রেলওয়ে কর্মচারীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা দেওয়া এবং সাধারণ মানুষের কাছে সেবাদানের ক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করা।
তবে কার্যকরভাবে শুধু নাম ছাড়া আর তেমন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এটির বর্তমান নাম - ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল’।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। হাসপাতালটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে, তা নিয়ে মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য ও রেল মন্ত্রণালয়।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের বিপরীতে আউটার সার্কুলার রোডে হাসপাতালটির অবস্থান। প্রবেশপথের জীর্ণশীর্ণ নামফলকটি জানান দেয়, এখানে চিকিৎসা সেবা সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু, রেলওয়ে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং পরিচালনা কমিটির দায়িত্বহীনতার কারণে হাসপাতালটি রোগী টানতে ব্যর্থ হয়ে দিনে দিনে নিজেই যেন রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা শহরের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে সবুজ গাছপালা ঘেরা শান্ত পরিবেশে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮৬ সালে। রেল মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি, বাজেট স্বল্পতা এবং রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ছাপ হাসপাতালটির সর্বত্র দৃশ্যমান। আসবাবপত্র ও মেডিকেল সরঞ্জামের জরাজীর্ণ অবস্থা দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে বহু আগে। এসব যাদের দেখার কথা তারা যে দেখছেন না, তা বুঝতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
গত বছর (২০১৯) সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত একাধিকবার পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রতিবেদক হাসপাতালটির চিকিৎসক, সেবিকা এবং কর্মীদের অলস সময় পার করতে দেখেন। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া এখানে রোগীর উপস্থিতি খুব কম। চিকিৎসা না হওয়ায় রোগীও আসে না।
নগরীর অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় এখানকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। হাসপাতালটি পরিদর্শনের সময় দুইদিনের রেজিস্ট্রি ঘেঁটে ১০ জনেরও কম রোগীকে ভর্তি হতে এবং ৫০ জনের মতো রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে।
কম রোগী আসার ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের উন্নয়ন যৌথ কমিটির সদস্য ডা. আবদুল আহাদ বলেন, “কারণ পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব। এখানে রোগ পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই এবং ওষুধ সরবরাহও কম।”
তিনি আরও বলেন, “রোগ নির্ণয় করার জন্য আমাদের রোগীদেরকে অন্যান্য হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাতে হয়। যদি কোনো রোগী এক জায়গায় সবরকম সুবিধা না পান, তবে তিনি কেনো আসবেন?”
বিভাগীয় এ মেডিকেল অফিসার জানান, তারা কেবল রক্ত, মূত্র এবং এক্সরে’র মতো কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা করতে পারেন। হাসপাতালটিতে কোনো আধুনিক সার্জারি কিংবা আইসিইউ সুবিধা নেই।
তিনি বলেন, “রোগীর অভাবে ৭৫ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটি এখন কমে ৪০ শয্যায় এসে ঠেকেছে।”
যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আহাদ বলেন, “এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সব সহায়তা না দেওয়ায়, এ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।”
২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি অনুসারে, দুই মন্ত্রণালয় (স্বাস্থ্য ও রেল) কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পরিচালিত সাত সদস্যের একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তাদেরকে পরিচালক নিয়োগ, হাসপাতালের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিগুলোর তালিকা তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ এবং অকেজো চিকিৎসা সরঞ্জাম মেরামত ও বদলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের এ কমিটি, হাসপাতালটি আধুনিকীকরণের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি। এর কারণ হিসেবে মূলত দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিরোধের কথা বলা যেতে পারে।
হাসপাতালের সম্পদ তালিকাকরণের জন্য এখনও কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। এমনকি, গত দুই বছরে ব্যবস্থাপনা কমিটি একটি বৈঠক করেনি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, এই অচলাবস্থা সমাধানের জন্য তিনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি সভা আহ্বান করবেন।
এ পদে নতুন দায়িত্ব পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এখনও কেনো কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়নি, সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।”
সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী, হাসপাতালের স্থাবর সম্পত্তিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য যৌথ কমিটির কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিলো। কিন্তু এখনও সেটি করা হয়নি বলে দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিনিধি হিসেবে একজন পরিচালক ও সাতজন চিকিৎসক নিয়োগের পরেও হাসপাতালটি প্রায় অচল অবস্থায় রয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফিরোজ আলমগীর রোগীদের অনুপস্থিতির জন্য প্রচারের অভাবকে দায়ী করেছেন।
তিনি জানান, কিছু ডাক্তার নিয়োগ করা ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে হাসপাতালের জন্য এখনও কোনো আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন না তারা।
তিনি আরও জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কমিটি তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না দিয়েই হাসপাতাল পরিচালনার জন্য নিয়োগ করেছে।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে টানাপড়েন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আমিনুল হাসান জানান, তারা হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগ করেছেন। কিন্তু, এর বাইরে রেল মন্ত্রণালয় সম্পত্তি হস্তান্তরের অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত অন্যান্য সহায়তার ক্ষেত্রে তারা কিছু করতে পারবেন না।
কমিটির আরেক সদস্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বলেন, “অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি ধীরে ধীরে হাসপাতালটিকে ৫০০ শয্যাতে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিলো, তবে সম্পত্তির মালিকানার ঝামেলায় এ পরিকল্পনাটি আটকে গেছে।”
এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, “সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা কমিটি হাসপাতাল পরিচালনা করবে, যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি (আহবায়ক) তো দীর্ঘদিন ধরে কোনো সভাই ডাকেননি।”
তিনি আরও জানান, রেলওয়ের হাসপাতালের কোনো সম্পত্তি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে হস্তান্তর করা হবে না।
গত বছরের নভেম্বরে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “এটা আমার নজরে এসেছে যে- হাসপাতালটির তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। আমি আমার কর্মকর্তাদের একটি কমিটি গঠন এবং এটি সম্পর্কে একটি বিস্তৃত রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি।”
তিনি জানান, রিপোর্ট পাওয়ার পরে কে এই হাসপাতালটি চালাবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
রেল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং কমিটির সদস্য প্রণব কুমার ঘোষ জানিয়েছেন, তারা সরকারি আদেশ পাওয়ার পরে কাজ শুরু করবেন।
আরও পড়ুন:
ক্যান্সার হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন: জনঅর্থ অপচয়-অনিয়মের একটি ক্ষুদ্র নমুনা
ক্যান্সার হাসপাতাল পরিচালকের অবসরকালীন সুবিধা স্থগিতের নির্দেশ হাইকোর্টের
Comments