দেশের পথে বঙ্গবন্ধু
সেই সংবাদ ছিল স্বপ্নময়তায় ভরা, মুহূর্তেই যার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল সুরের মূর্ছনার মতো... পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন, ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের পথে বঙ্গবন্ধু। যে কারাগারে দীর্ঘ নয় মাস বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন হুমকিতে।
আমাদের নেতা সুস্থ আছেন, আমাদের কাছে ফিরছেন- যাদেরকে বঙ্গবন্ধু নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন, যাদের মুক্তির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন... আনন্দের এই বার্তা ছিল তাদের কাছে বাঁধভাঙা।
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বর্ণনাতীত, যারা সেই সময়ে ছিলেন না তাদের বোঝানো সম্ভব নয়, একজন মানুষ আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে তার মুগ্ধতা দিয়ে কতটা জায়গা করে নিয়েছিলেন, যাকে ছাড়া আমাদের স্বাধীনতাও ছিল অপূর্ণ। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে যার ফিরে আসা ছিল অপরিহার্য।
মুজিববর্ষ- বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনে দ্য ডেইলি স্টার তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মুজিব কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই কথাই তুলে ধরবে।
১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি, ভোরের লন্ডন তখন ঘুমিয়ে ছিল, আর সেখানকার আবহাওয়া ছিল বরফাছন্ন।
দেশে ফিরবেন বঙ্গবন্ধু। তাই নজরদারি এড়াতে বঙ্গবন্ধুকে ক্লরিজ হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে চুপিচুপি এয়ারপোর্টে নেওয়া হলো।
বঙ্গবন্ধুর জন্য আগে থেকেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সিলভার আরএএফ জেট প্রস্তুত ছিল।
জেটটি সকাল ৭ টার দিকে যাত্রা শুরু করলো।
সবাইকে বলা হয়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে করে দেশে ফিরবেন বঙ্গবন্ধু। তবে, তা ছিল একটি কৌশল মাত্র।
বিমানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন, তার পরিবার এবং দুই ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী ও ভেদ মারওয়া।
শশাঙ্ক ব্যানার্জী এই ঐতিহাসিক ভ্রমণকে তার India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan বইয়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিশন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
শশাঙ্ক ব্যানার্জীর কাছে আগেই একটি নোট পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি কী বলবেন এবং তার কাছ থেকে কী আশা করা যায়, সেসব দিকনির্দেশনা ছিল ওই বিবরণীতে।
শশাঙ্ক ব্যানার্জী তার বইয়ে জানিয়েছে, “যাত্রা শুরুর আগে কিছু মজার ঘটনা ঘটল। বিমানটি যখন প্রস্তুত হচ্ছিল তখন আমি দরজার কাছে দাঁড়ানো। সেসময় সেখানে আসেন ইয়ান সাদারল্যান্ড (ব্রিটিশ কূটনীতিক) এবং আমাদের শুভ কামনা জানান। তবে, তিনি কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে ইঙ্গিতে অতিথির দেখাশোনা করতে বলেছিলেন। আমিও তাকে ইঙ্গিতে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম, তার চিন্তার দরকার নেই। আমি তার চোখে এক টুকরো হাসি দেখেছিলাম, কারণ তিনি জানতেন আমি কী করতে চাইছি।”
ব্যানার্জীকে বঙ্গবন্ধুর পাশের আসনেই বসতে বলেছিলেন ইয়ান সাদারল্যান্ড।
জোড়া আসনের সামনেই একটি ডেস্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু সেখানে তার পাইপ এবং প্রিয় এরিনমোর তামাক রেখেছিলেন।
“কিছু সময় আড্ডা ও খুনসুটির পরে আমরা কমলার রস পান করলাম। বিমানটি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী মুজিব ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি আমার কাছে বড় কোনও সাহায্য চাইতে পারেন কী না। তবে, তার আচরণে একটুও দ্বিধা ছিল না। আমি ইতিবাচকভাবে জবাব দিয়ে বলেছিলাম, আমার সামর্থ্যের মধ্যে হলে পারবো।”
বঙ্গবন্ধু শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি ভবনে বৈঠকের আগে দিল্লি পৌঁছে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতে চান তিনি।
“আমি প্রথম কয়েক সেকেন্ডের জন্য নার্ভাস ছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না মুজিবের উদ্দেশ্য কী ছিল? আমি ভাবছিলাম উৎসবমুখর পরিবেশের মাঝে কীভাবে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর কানে মুজিবের বার্তা পৌঁছে দিবো? আমার কাছে মুজিবের অনুরোধের বার্তাটি ছিল, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যেন সেনা প্রত্যাহারের সময়সূচীর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেন।”
বঙ্গবন্ধু তাকে জানিয়েছিলেন, এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ভারত যদি ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত সময়সীমা ৩০ জুনের তিন মাস আগে বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে রাজি হয়, তাহলে বাংলাদেশকে দ্রুত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবে ব্রিটেন।
ব্যানার্জী আরও বলেছিলেন, “মুজিব এই অনুরোধে নিজের ইচ্ছাকেও যুক্ত করলেন। তিনি চেয়েছিলেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ ইশতেহারে প্রতিফলিত হোক যা দিল্লিতে আলোচনা শেষে জারি করা হয়।”
ভ্রমণের সময় মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু আবেগী হয়ে উঠছিলেন।
“শারজা থেকে জ্বালানি নেওয়ার পরে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করলো। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে মেঘ দেখছিলেন। কিছু সময় পরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং গাইতে শুরু করলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’”
বঙ্গবন্ধুর চোখ দুটি অশ্রু সজল হয়ে উঠে। তিনি বললেন, “ব্যানার্জী, আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। আসুন একসঙ্গে সুর ধরি।”
“ভ্রমণ যেন শেষ হচ্ছিলো না। বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ, মানুষ এবং প্রকৃতি আমাকে ডাকছে। এই অনুভূতি আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না।” ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জী।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে, ড. কামাল হোসেনের আত্মজীবনী “Bangladesh: Quest for Freedom and Justice”, প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর লেখা বই “India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan, ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এম এম রেজাউল করিমের একটি প্রবন্ধ এবং প্রথম আলোতে প্রকাশিত শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর একটি সাক্ষাৎকার অবলম্বনে।)
আরও পড়ুন:
Comments